কৈলাস থেকে দেবী দুর্গা এসেছেন বাবার বাড়ি। মহা ধূমধামের সঙ্গে তাঁর পূজা হচ্ছে সারা বাংলায়। আর কলকাতা থেকে পুরান ঢাকার দক্ষিণ মৈশুন্ডির বাবার বাড়ির স্মৃতি নিয়ে প্রায় ৪০ বছর পর ঢাকায় এসেছেন গৌরী চক্রবর্তী। সঙ্গে স্বামী আর কে চক্রবর্তী। গতকাল মঙ্গলবার মহাসপ্তমীর পূজার সন্ধ্যা আরতির সময় তাঁদের সঙ্গে দেখা হলো বনানী মাঠের পূজামণ্ডপে।
বনানী মাঠের অর্ধেকটা জুড়ে বিশাল মন্দির। সামনের খোলা চত্বর। পশ্চিম পাশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ। ঢাকা শহরে শারদীয় দুর্গাপূজায় এবার বনানী মাঠের এই পূজা হচ্ছে ব্যাপক জাঁকজমকের সঙ্গে। গতকাল মঙ্গলবার মহাসপ্তমীতে ভক্তদের সমাগমও হয়েছিল প্রচুর।
গুলশান-বনানী এলাকায় কোনো মন্দির নেই। ২০০৮ সাল থেকে রাজধানী উন্নয়ন করপোরেশনের বনানী মাঠ ভাড়া নিয়ে দুর্গাপূজার আয়োজন করছে গুলশান-বনানী সর্বজনীন পূজা পরিষদ। প্রতিবছরই এই পূজার জাঁকজমক বাড়ছে। পরিষদের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র ঘোষ, সম্পাদক সুধাংশু কুমার দাস, কোষাধ্যক্ষ প্রাণ কৃষ্ণ ঘোষ ও নির্বাহী সদস্য রঞ্জন কর্মকারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল আয়োজন নিয়ে। তাঁরা জানালেন, যেহেতু এখানে স্থায়ী মন্দির নেই, তাই এবার মাঠের অর্ধেকটা জুড়ে মন্দিরের অবকাঠামো করা হয়েছে। প্রধান ফটক ও দেয়ালগুলো নকশা করা হয়েছে দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মন্দিরগুলোর নকশার অনুসরণে। প্রধান ফটকটি প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু। কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে আসতে হয়। ভক্তরা যেন মন্দিরে প্রবেশের অনুভূতি বোধ করতে পারেন, সেই বিষয়টি ভেবেই এবার পূজামণ্ডপের সাজসজ্জা করা হয়েছে। তাঁরা জানালেন, এ বছর বনানীতে পরিষদের একটি নিজস্ব অফিস করা হয়েছে। তাঁরা জোর চেষ্টা করছেন গুলশান-বনানী এলাকায় একটি সুবিধামতো জায়গায় মন্দির নির্মাণের।
বনানী পূজামণ্ডপে গতকাল মহাসপ্তমীর সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিরতিহীন প্রসাদ বিতরণ করা হচ্ছে। চলবে বিজয়া দশমী পর্যন্ত।
মণ্ডপের সামনে চেয়ার পেতে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে বসে সন্ধ্যা আরতি দেখছিলেন আর কে চক্রবর্তী ও তাঁর স্ত্রী গৌরী চক্রবর্তী। গত সোমবার ঢাকার পূজা দেখতেই তাঁরা কলকাতা থেকে এসেছেন। অন্য একটি কারণও অবশ্য আছে। গৌরী জানালেন তাঁদের পৈতৃক বাড়ি ছিল পুরান ঢাকার দক্ষিণ মৈশুন্ডিতে। সেখানে অবশ্য এখন আর কেউ থাকেন না। তবে ইচ্ছে আছে কাল (বুধবার) ঢাকেশ্বরী মন্দিরে মহাঅষ্টমীর পূজা দিয়ে সম্ভব হলে একবার মৈশুন্ডি এলাকায় যাবেন। সর্বশেষ ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৭৪ সালের দিকে। অবসরজীবন যাপন করছেন তাঁরা।
আর কে চক্রবর্তী জানালেন, কলকাতার পূজায় যে ভিড়ভাট্টা হয় তাতে এই বয়সে আর ঘর থেকে বের হয়ে মন্দিরে যাওয়া হয়ে ওঠে না। ঢাকায় বনানীর পূজা বেশ ছিমছাম মনে হচ্ছে তাঁদের।
সন্ধ্যায় আগারগাঁও থেকে তুষার হালদার স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন দেবী দর্শন করতে। তিনি জানালেন, এক দিনে সব মণ্ডপে যাওয়া যাবে না। অষ্টমী ও নবমীতে যাবেন সিদ্ধেশ্বরী-ঢাকেশ্বরী ও পুরান ঢাকায়।
বনানীর শারদীয় উৎসবে জমজমাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে প্রতিদিন আরতির পর। গতকাল ছিল শিশুদের পরিবেশনা ও ইসকনের আয়োজনে শ্রীকৃষ্ণের জীবনভিত্তিক বিশেষ পরিবেশনা। উপস্থাপনায় ছিলেন মনোজ সেনগুপ্ত। আজ মহাঅষ্টমীর সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করবেন ফেরদৌস আরা, চন্দনা মজুমদার, ফাহিম হোসেন চৌধুরী ও আবু বকর সিদ্দিক। নৃত্য পরিবেশন করবেন প্রেমা ও তাঁর দল এবং লেজার নৃত্য পরিবেশ করবেন পূজা সেনগুপ্ত।
বনানী ছাড়াও কলাবাগান মাঠেও হচ্ছে জমজমাট পূজা। গতকাল সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল মন্দির, ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দিরে বিকেল থেকেই দেবী দর্শনে ভক্তদের প্রচুর সমাগম ঘটে।
মুন্সিগঞ্জ: গতকাল সকাল থেকেই বিভিন্ন মণ্ডপে নারী-পুরুষ দেবীর পূজা-অর্চনা করেন। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করেন। এ বছর জেলার ২৭৯টি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে। এদিকে গতকাল শহরের বাগমামুদালিপাড়ায় রাধা-গোবিন্দের মন্দিরসংলগ্ন বালুর মাঠে সর্বজনীন দুর্গাপূজায় দেড় শতাধিক দরিদ্র মানুষের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনের সাংসদ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদপ্তর সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস।
নারায়ণগঞ্জ: জেলায় এ বছর ১৯২টি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে। দুর্গোৎসব উপলক্ষে নগরীর প্রধান সড়কগুলোতে সুউচ্চ তোরণ শোভা পাচ্ছে। নগরীর আমলাপাড়া, উকিলপাড়া, টানবাজারের বঙ্কবিহারী আখড়া, সাহাপাড়া, নিতাইগঞ্জের বলরাম জিউর আখড়ার মণ্ডপের সাজসজ্জা চোখে পড়ার মতো।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোখলেছুর রহমান বলেন, নারায়ণগঞ্জে ৩৫০ জন পুলিশ, ১ হাজার আনসার ও র্যাব সদস্য একযোগে নিরাপত্তার দায়িত্বে কাজ করছেন। স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ মণ্ডপগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং সার্বিক পর্যবেক্ষণের জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
গাজীপুর: জেলায় মোট ৩৫০টি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে। ইতিমধ্যে মণ্ডপগুলোতে প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। পুলিশ সুপার কার্যালয়ের বিশেষ শাখা সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জয়দেবপুর থানায় ৮৭টি, টঙ্গীতে আটটি, কালিয়াকৈরে ১১১টি, শ্রীপুরে ৪৮টি, কাপাসিয়ায় ৫০টি ও কালীগঞ্জে ৩৬টি মণ্ডপ স্থাপন করা হয়েছে। পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ বলেন, জেলার প্রতিটি মণ্ডপে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গাজীপুর শহরের কৃতাময়ী কালীমন্দিরের সভাপতি নিখিল চন্দ্র দাস বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে তাঁরা পূজার কার্যক্রম শুরু করেছেন।
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা): গতকাল দুপুরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আইন্তা, ব্রাহ্মণগাঁও, হাজারীবাগ ও মীরেরবাগ এলাকার বিভিন্ন মণ্ডপে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করা হয়। বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য অপর্ণা রায়। এ সময় কোন্ডা ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আফজাল হোসেন, যুবদলের আহ্বায়ক কৃষ্ণ তালুকদার, শ্রমিক দলের সভাপতি মো. দিপু, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আসাদুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।