বনের জমির প্রতি চার মামলার একটিতে হার

বন বিভাগ এত মামলায় হারে কেন, প্রশ্ন সংসদীয় কমিটির। সরকারি হিসাবে ২ লাখ ৫৭ হাজার একর বনভূমি বেদখল।

সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী আগে থেকেই আগামরা ও লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে বিপন্ন ছিল। ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তও হয় এ গাছ। আর গেওয়া বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বেশি টিকে থাকে। সম্প্রতি কটকার জামতলা এলাকায়ছবি: ফরিদী নুমান

বনের জমি নিয়ে যতগুলো মামলার রায় হয়েছে, তার ২৪ শতাংশে হেরেছে বন বিভাগ। এর মানে হলো, প্রতি চারটি মামলার একটিতে হারতে হয়েছে বন বিভাগকে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেওয়া বন বিভাগের এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। কমিটি মনে করে, মামলায় বন বিভাগের হেরে যাওয়ার হার উদ্বেগজনক। গাফিলতি বা যথাযথ তদারকির অভাবেই বন বিভাগ অনেক মামলায় হারছে।

বন বিভাগ মামলায় হারের কারণে দেশের বনভূমি বেহাত হয়। বন বিভাগের হিসাবে দেশে প্রায় ২ লাখ ৫৭ হাজার একর বনভূমি অবৈধ দখলে রয়েছে। এর মধ্যে বড় অংশ সংরক্ষিত বনের জমি। বনের জমি দখল করে তৈরি করা হয়েছে পর্যটনকেন্দ্র ও শিল্পকারখানা। এ ছাড়া ঘরবাড়ি নির্মাণ ও কৃষিকাজও করা হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে আজ রোববার পালিত হবে আন্তর্জাতিক বন দিবস। ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন এ দিনকে বন দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘বন পুনরুদ্ধার: উত্তরণ ও কল্যাণের পথ’।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, বন বিভাগ কেন মামলায় হেরে যাচ্ছে, আইনজীবীর কোনো গাফিলতি আছে কি না বা ইচ্ছাকৃতভাবে মামলা হারছে কি না, মন্ত্রণালয় তা খতিয়ে দেখবে। ইতিমধ্যে এসব বিষয় পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, মামলায় হারার চিত্র সব জায়গায় এক রকম নয়। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে হেরে যাওয়া মামলার সংখ্যা বেশি। সেখানে মামলাও বেশি।

কত মামলা, কয়টিতে হার

বন বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী বনের জমি নিয়ে ২ হাজার ৯৪৭টি মামলা চলছে। গত বছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত রায় হয়েছে মোট ২ হাজার ৩৩৬টিতে। বন বিভাগ হেরেছে ৫৫৭টি মামলায়। আর জয়ী হয়েছে ১ হাজার ৭৭৯টিতে। এই মামলা মূলত ফরেস্ট সেটেলমেন্ট আদালতে হওয়া। আইনে ফরেস্ট সেটেলমেন্ট কর্মকর্তাকে দেওয়ানি আদালতের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, ঢাকা; সামাজিক বন বিভাগ, রাজশাহী; সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ, খুলনা; কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ, কক্সবাজার; কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ; ময়মনসিংহ বন বিভাগ; টাঙ্গাইল বন বিভাগ ও সিলেট বন বিভাগ—এই আট বিভাগে মামলাগুলো হয়।

বন বিভাগ হারতে চায় বলেই বনের জমির মামলায় হারে। এর পেছনে দুর্নীতি ও যোগসাজশ রয়েছে। সরকার জিততে চেয়েছে, কিন্তু হেরে গেছে, এমন মামলার নজির খুব কম।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান নির্বাহী, বেলা

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৫ মার্চ সংসদীয় কমিটি বন বিভাগের ভূমি উদ্ধারে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীদের পারদর্শিতা নিয়ে আলোচনা করে। ওই বৈঠকে বন বিভাগ মামলা নিয়ে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করে। বৈঠকে কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, বনের জমি নিয়ে মামলার রায় সরকারের বিপক্ষে খুব বেশি ক্ষেত্রে যাওয়ার কথা নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ইচ্ছা করেই মামলায় হারছে কি না, তা নিয়েও কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেন। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে সংসদীয় কমিটির আরেক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এতে কমিটির সদস্য নাজিম উদ্দিন আহমেদ বন বিভাগের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী অবৈধ দখলদারদের মাধ্যমে প্রভাবিত হন বলে অভিযোগ তোলেন।

মামলায় হেরে যাওয়ার হারটিকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যে আইনজীবীকে সর্বোচ্চ পরিমাণে টাকা দেওয়া হয়েছে, তিনি সবচেয়ে বেশি মামলায় হেরেছেন। জনগণের করের টাকায় তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়।

বেশি মামলা ময়মনসিংহে

বনের জমি নিয়ে মামলা সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহ বিভাগে। মামলায় হারার সংখ্যাও এ বিভাগে বেশি। প্রতিবেদন অনুযায়ী ময়মনসিংহ বিভাগে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৫৩২টিতে হেরেছে বন বিভাগ। অর্থাৎ ২৯ শতাংশ মামলায় সরকার পক্ষ হেরেছে। এ ছাড়া কক্সবাজারেও মামলায় হারার হার বেশি। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগে এখন ২১২টি মামলা চলছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ১৬টি। এর মধ্যে ৭টিতেই হেরেছে বন বিভাগ।

হারার কারণ জানতে চাইলে ময়মনসিংহের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ কে এম রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বনের জমির সঙ্গে মানুষেরও জমি থাকে। এ জমি নিতে হলে ডিমার্কেশনের (চিহ্নিত করা) জন্য মামলা করেই নিতে হয়। তখন বন বিভাগ বিবাদী হয়। এ ধরনের মামলার সংখ্যাও এখানে যুক্ত আছে, যে কারণে হেরে যাওয়া মামলা বেশি দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ফরেস্ট সেটেলমেন্ট আদালতে অনেক রায় বন বিভাগের বিপক্ষে গেলেও পরবর্তী সময়ে আপিলে পক্ষে আসে।

আইনজীবীরা ইচ্ছা করেই মামলা হারছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে রুহুল আমিন বলেন, তাঁরা সব লিখিত আকারে দেন। ফলে সরাসরি বিপক্ষে বলার সুযোগ আইনজীবীর থাকে না। তবে অন্য পক্ষ হয়তো সহযোগিতার জন্য তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। কিন্তু আদালতকে প্রভাবিত করার সুযোগ আসলে কতটুকু আছে, এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, এখন থেকে তাঁদের কর্মকর্তারাও আইনজীবীর সঙ্গে থাকবেন।

বনের বিপুল জমি বেদখল

বন বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর। এর মধ্যে যে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর বনভূমি অবৈধ দখলে রয়েছে, তার দখলদার ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৬ জন। মোট বেদখল জমির প্রায় ৫৪ শতাংশই সংরক্ষিত বনের, পরিমাণের দিক দিয়ে তা ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ একর।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বনের জমি নিয়ে মামলা ও জমি উদ্ধারের বিষয়টি সংসদীয় কমিটি সামনে আনার পর বন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা মামলার কার্যক্রম তদারকি নিশ্চিত করতে সব বিভাগীয় কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছে।

সরকারের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠি

সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা আরও দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলার জন্য সম্প্রতি সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। গত ৩০ ডিসেম্বর দেওয়া এ চিঠিতে বলা হয়, সরকারপক্ষে যথাযথ পদক্ষেপ না নিতে পারায় অনেক ক্ষেত্রে মামলার রায় সরকারের বিরুদ্ধে যায়। এতে সরকারের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে সরকার বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে।

চিঠিতে দেওয়া তিনটি নির্দেশনা হলো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের আইন শাখার সক্ষমতা বাড়ানো, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে মামলা তদারকি করা এবং কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সরকারি স্বার্থ বিবেচনায় যানবাহনসুবিধা ও ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। চিঠিতে সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলার বিষয়ে নিবিড় তদারকির নির্দেশনা দেওয়া হয় সচিবদের।

বন বিভাগের মামলার বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বন বিভাগ হারতে চায় বলেই বনের জমির মামলায় হারে। এর পেছনে দুর্নীতি ও যোগসাজশ রয়েছে। সরকার জিততে চেয়েছে, কিন্তু হেরে গেছে, এমন মামলার নজির খুব কম। তিনি বলেন, বনকে রক্ষা করতে হলে সিএস ম্যাপ অনুযায়ী সীমানা চিহ্নিত করে ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে। জমি নিয়ে যেসব বিরোধ রয়েছে, তা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে সমাধান করতে হবে।