বন্ধু ও সহকর্মী মোহসীন চৌধুরীকে যেমন দেখেছি

কোভিড-১৯ দুঃস্বপ্নের মতো পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছে, যা কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। প্রথম দিকে মনে হয়েছিল, অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধির মতো করোনাও আশপাশের কোনো দেশ অথবা মানুষকে আক্রান্ত করে চলে যাবে। কিন্তু তা পৃথিবীকে এভাবে অস্থির ও স্থবির করে রাখবে, এ যেন এখনো অবিশ্বাস্য। কত কাছের মানুষ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, অগ্রজ-অনুজ সহকর্মী মাত্র কয়েক দিনের নোটিশে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। শেষ মূহূর্তে তাদের কাছে থেকে দেখারও কোনো সুযোগ হয়নি অথবা সাহস হয়নি। তেমনি একজন আমার বন্ধু ও সহকর্মী পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী, যিনি এত দ্রুত পৃথিবী থেকে চলে গেছেন, যা মনে নিতে কষ্ট হয়।

বন্ধু অনেকেই থাকে। কিন্তু তাদের মধ্যেও এমন কিছু বন্ধুর সৃষ্টি হয়ে যায়, যারা হৃদয়ের মানসপটে স্থায়ী আসন করে নেয়। আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের সহপাঠী, কর্মজীবনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বিশাল হৃদয়ের অধিকারী আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী কথা অত্যন্ত কম বলতেন। কিন্তু তাঁর সহপাঠী ও সহকর্মীদের প্রতি ছিল অত্যন্ত দরদ, যা আমি আমার ছাত্রজীবনে ও কর্মজীবনে তাঁর মধ্যে দেখেছি।

আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয়করা গ্রামের এক স্বনামধন্য মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন আদমজী জুট মিলের চিফ লেবার অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অফিসার। তাঁর প্রতিটি ভাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দেশে–বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর গুণাবলি এই স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। শুধু আমার স্মৃতির ভান্ডারে সংরক্ষিত কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করার ক্ষুদ্র প্রয়াস নিলাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে অধ্যয়নকালে আমি শহীদুল্লাহ হলের এবং মোহসীন পাশাপাশি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। স্বল্পভাষী হলেও অত্যন্ত শান্তশিষ্ট, নম্রভাবাপন্ন মোহসীন সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা হলেই কুশলবিনিময়সহ বন্ধুদের উপকারে নীরবে–নিবৃত্তে উজাড় করে দিতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ভর্তি হই ১৯৭৯-৮০ সেশনে। দীর্ঘ পাঁচ–ছয় বছর আমাদের একসঙ্গে পথচলা। তাঁকে কোনো বন্ধুর সঙ্গে রাগ করে কথা বলতে দেখেছি, এমনটা আমার মনে পড়ে না। বরং সহপাঠীদের সঙ্গে যেকোনো দুঃসময়ে আলোকবর্তিকা হয়ে স্বমহিমায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে দেখেছি।

কর্মজীবনেও ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা একই দিনে যোগ দিই। কর্মকালীন তাঁর সঙ্গে আমার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। তিনি তখন ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। পরবর্তীকালে ওই মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলে যান এবং কোভিডে আক্রান্ত অবস্থায় হাসপাতালে থাকাকালে সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। কিন্তু তাঁর আকস্মিক মৃত্যু সিনিয়র সচিব হিসেবে অফিসে বসার আর সুযোগ হয়নি।

মোহসীনের অধীনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কাজ করলেও তিনি কোনো দিন বন্ধুত্বের বন্ধন থেকে আমাকে বঞ্চিত করেননি। প্রকাশ্যে না হলেও অপ্রকাশিত অবস্থায় আমি তা বিভিন্ন সময় আঁচ করতে পেরেছি। ফলে মন্ত্রণালয়ে আমি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।

আরেকটি বিশেষ গুণ ছিল মোহসীনের—কোনো অমীমাংসিত বিষয় তাঁর কাছে এলে তা গভীরভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে তিনি নিজে যেমন জড়িত হতেন, তেমনি সহকর্মীদেরও সেভাবে নির্দেশনা দিয়ে বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করতেন।

আমি আগেই বলেছি, মোহসীন স্বল্পভাষী হলেও অনুজ সহকর্মীদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল অসাধারণ। আমি প্রশাসন অনুবিভাগের দায়িত্বে থাকায় খুব কাছ থেকে দেখেছি, অনুজ সহকর্মীদের বিভিন্ন সুবিধা–অসুবিধা তিনি অত্যন্ত দরদ দিয়ে অনুভব করতেন এবং সমাধানের চেষ্টা করতেন। অনুজ সহকর্মীরা যাতে যথাসময়ে পদোন্নতি পান, সে বিষয়ে সব সময় সজাগ ছিলেন। কর্মকর্তা ও স্টাফদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনুবিভাগ, অধিশাখা বা শাখায় পদায়নের ক্ষেত্রে অনেক কিছু বিচার–বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নিতেন। ফলে অফিসে সুন্দর চেইন অব কমান্ড সৃষ্টি হতো। অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা করাও সহজ হতো।

অফিসে কোনো ধরনের লজিস্টিক সাপোর্টের সাময়িক সমস্যা হলে বিষয়টি সমাধানের জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করতেন। এর জন্য কখনো কাউকে দায়ী করে কোনো মন্তব্য করতে তাঁকে দেখিনি। এমনকি কাউকে ধমক দিয়ে বলেননি, কেন হয়নি। অফিসের অধিকাংশই বিকাল পৌনে পাঁচটা বা পাঁচটার মধ্যে অফিস ত্যাগ করলেও তিনি ফাইল শেষ না হওয়া পর্যন্ত অফিস ত্যাগ করতেন না এবং একেবারে জরুরি প্রয়োজন না হলে অন্য অফিসার ও স্টাফদের খুঁজতেন না।

সভার কর্মপত্র বা নথিতে কোনো ভুল বা সঠিক প্রতীয়মান না হলে এর জন্য তেমন কোনো মন্তব্য করতেন না বা রাগ হতেন না। তিনি স্বভাবসুলভ মিষ্টি ভাষায়, কোমল স্বরে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। জুনিয়র সহকর্মীদের কখনো বকা দিতেন না। কোনো কিছুতে ভুল হলে বলতেন, বিষয়টি ভালোভাবে দেখা হয়নি। এটাই ছিল তাঁর সর্বোচ্চ বকা। তাঁকে কখনো সহকর্মীদের সঙ্গে তেমন রাগ করতে দেখিনি।

সভাকক্ষে সিনিয়র, জুনিয়র কর্মকর্তাদের প্রটোকল অনুযায়ী বসার বিষয়টিও তিনি নজরে রাখতেন। কোনো ব্যত্যয় হলে কৌশলে তিনি তা স্মরণ করিয়ে দিতেন, যাতে কেউ মনঃকষ্ট না পান।

মোহসীন ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বদলি হয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যান। এক দিন হঠাৎ শুনলাম, তিনি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা সিএমএইচে ভর্তি হয়েছেন। সে সময় দিনগুলো ছিল অত্যন্ত আতঙ্ক আর অস্থিরতায় ভরা। হাসপাতালে প্রায়ই টেলিফোন করে খোঁজ নিতাম। এর মধ্যেই কিছুদিন পর খবর পেলাম, তিনি অনেকটা সুস্থ হয়েছেন। তার অল্প কয়েক দিন পরই দুঃসংবাদ পেলাম, মোহসীন আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

মানুষ এ পৃথিবীতে আসে অল্প সময়ের জন্য। সবাইকেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়। কেউ আগে, আর কেউ পরে। কিন্তু থেকে যায় তাঁর কর্মফল ও সুখকর স্মৃতি। মোহসীন আমাদের সঙ্গে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর সুখকর স্মৃতি ও অসাধারণ কর্মকাণ্ড। এ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

মোহসীন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর টেলিফোনে যোগাযোগ করলে মনে হতো আপনি আমাদেরই সাহস দিতেন। আপনি বলতেন, আগের চেয়ে ভালো আছেন। আমরাও আশাবাদী ছিলাম, আপনি আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন। কিন্তু এলেন না। আপনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। পরপারে ভালো থাকুন। মহান রাব্বুল আলামিন আমার এই সৎ, পরোপকারী ও কর্মবীর বন্ধুর সব গুনাহ মাফ করে জান্নাত নসিব করুন।

*অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল), পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়