বন্ধুচুলা কেন

প্রচলিত চুলা
¥ বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ পরিবার রান্নার জন্য প্রচলিত চুলা ব্যবহার করে
¥ প্রচলিত চুলার ধোঁয়ায় দেশে প্রতিবছর ৫০ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হয়। ২৫ লাখ মানুষ হাঁপািনতে কষ্ট পায়। রান্নার জন্য প্রতিবছর প্রায় ১৫০ কোটি মণ জ্বালানি খরচ হয়। ফলে দিন দিন বন সংকুচিত হচ্ছে
¥ প্রচলিত চুলায় বাতাসে অধিক কার্বন নিঃসরণের ফলে পরিবেশ দূষিত হয়
বন্ধুচুলার সুফল
¥ ধোঁয়াজনিত রোগ থেকে ৫০ হাজার নারী ও শিশুর অকালমৃতু্য রোধ
¥ ধোঁয়া না হওয়ায় লাখ লাখ মানুষের মাথাব্যথা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, চোখের রোগ ইত্যাদি থেকে মুক্তি
¥ জ্বালানি অর্ধেক বেঁচে যাওয়ার কারণে ৭০ কোটি মণ লাকড়ির সাশ্রয়
¥ কম কার্বন নিঃসরণের ফলে বায়ুদূষণ অনেক কমবে
সূত্র: ডিআইজেড, বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশন
আলোচনায় সুপারিশ
* পুরুষদের রান্নাঘরে পাঠাতে হবে। পুরুষেরা রান্না করেন না। রান্নাঘরের দুর্গতি তাঁরা বোঝেন না
* ২০২১ সালের মধ্যে সব মানুষকে বন্ধুচুলা দিতে হলে এর ব্যাপক প্রচারে জনপ্রতিনিধি ও জাতীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন
* ব্যবহারকারীদের বৈচিত্রে্যর জন্য চুলার মধ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে
* বন্ধুচুলার ফলপ্রসূ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে প্রচলিত চুলা ব্যবহারের অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য অনেক কর্মশালা করতে হবে
* সামান্য সমস্যার কারণে অনেকে উন্নত চুলা বাদ দিয়ে দেন। যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁদের উচিত দ্রুত সমস্যা ঠিক করে দেওয়া
* উন্নত চুলায় রান্না করলে নারী ও শিশুদের ধোঁয়াজনিত রোগ হবে না
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: বন্ধুচুলা হলো পরিবেশবান্ধব চুলা। এ চুলায় ধোঁয়া কম হয়। রান্নাঘরে বায়ুদূষণ হয় না। শিশুরা নিরাপদ থাকে। যিনি রান্না করেন, তিনিও ধোঁয়াজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হন না। জ্বালানি সাশ্রয় হয়। জ্বালানি কম লাগায় পরিবেশদূষণ কম হয়।
বাংলাদেশ সায়েন্স ল্যাবরেটরি (বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ) গবেষণার মাধ্যমে এ ধরনের চুলা উদ্ভাবন করে। বর্তমানে জিঅাইজেডের সহযোগিতায় বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশন উন্নত চুলাকে বন্ধুচুলা নামে সম্প্রসারণ করছে। দেশের পরিবারগুলো যাতে এ ধরনের স্বাস্থ্যসম্মত চুলা ব্যবহার করে, সে জন্য তাদের সচেতন করা প্রয়োজন। আজকের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু উপস্থাপন করছেন খালেকুজ্জামান।
খালেকুজ্জামান

রান্নায় ব্যবহৃত প্রচলিত চুলার ধোঁয়া রান্নাঘরের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। রান্নাঘরের পরিবেশ দূষিত হয়। স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। এসব চুলার জ্বালানি দক্ষতা মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৫০ কোটি মণ জ্বালানি ব্যবহৃত হয়।
প্রতিবছর ৫০ হাজার শিশু ও নারী শুধু রান্নাঘরের ধোঁয়াজনিত রোগে মারা যায়। ২৫ লাখ মানুষ হাঁপানি রোগে কষ্ট পায়। জ্বালানির অপচয় ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে বন উজাড় হচ্ছে, পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ আশির দশকে বিভিন্ন মডেলের উন্নত চুলা উদ্ভাবন করে।
২০০৬ সালে জার্মান উন্নয়ন সংস্থা জিআইজেড চিমনিযুক্ত উন্নত চুলা সম্প্রসারণ শুরু করে। এই উন্নত চুলায় মাটির পরিবর্তে কংক্রিট ব্যবহৃত হয়। এ চুলা ‘বন্ধুচুলা’ নামে পরিচিত। দ্রুত বন্ধুচুলা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে জিআইজেড বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে।
বর্তমানে পাঁচ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা বন্ধুচুলা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা একটি বন্ধুচুলা ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করছেন। এ–যাবৎ প্রায় ২০ লাখ বন্ধুচুলা বিক্রি হয়েছে। বন্ধুচুলা ব্যবহার করলে ধোঁয়াজনিত অকালমৃত্যু রোধ হবে। লাখ লাখ মানুষ মাথাব্যথা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, চোখের রোগ ইত্যাদির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে।
জ্বালানি খরচ অর্ধেক হওয়ার কারণে ৭০ কোটি মণ জ্বালানি বেঁচে যাবে। তখন রান্নার জ্বালানির জন্য বনের গাছ কম কাটতে হবে। পরিবেশের সার্বিক উন্নতি ঘটবে। কম কার্বন নিঃসরণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তিন কোটি পরিবারে বন্ধুচুলা পৌঁছে দেওয়া আমাদের অঙ্গীকার।
আবি আবদুল্লাহ

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগে জলবায়ু ট্রাস্ট তৈরি হয়েছে। আমরা তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে ৪২০টি প্রকল্প নিয়েছি। এর মধ্যে ১৫০টি বাস্তবায়িত হয়েছে। আমাদের সফল প্রকল্পগুলোর মধ্যে বন্ধুচুলা প্রথম দিকে রয়েছে।
সাধারণত মানুষ চুলার কাছে যেতে চায় না। কিন্তু বন্ধুচুলার রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ চুলায় ধোঁয়া হয় না। বাইরে তাপ ছড়ায় না। এ চুলা দেখতেও অনেক সুন্দর। সবকিছু মিলিয়ে এ চুলার পরিচয় বন্ধুর মতো। প্রথম পর্যায়ে পাঁচ লাখ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে চার লাখ চুলার জন্য আমরা অর্থায়ন করেছি।
আমরা বিভিন্ন জেলার উদ্যোক্তা, জেলা, উপজেলা প্রশাসক—সবার সঙ্গে বন্ধুচুলার বিষয়ে আলোচনা করেছি। এসব আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে স্কুল, কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কীভাবে বন্ধুচুলার বিষয়ে সচেতন করা যায়। আমরা সিলেট জেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে যে সংখ্যক উদ্যোক্তা প্রয়োজন, সেটা নেই। সেখানে কাঠের পরিমাণ কম। বন্ধুচুলা ব্যবহার না করলে গাছপালা আরও কমে যাবে।
বন্ধুচুলা কার্যক্রমের আরও কিছু ভালো দিক রয়েছে। যেমন এর মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। নেতৃত্ব গড়ে উঠছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন।
বন্ধুচুলার যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁরা এখন স্বাবলম্বী। এ কাজের সঙ্গে তাঁরা অন্য কাজও করছেন। এ কাজ সফলভাবে করতে পারলে, দেশের জন্য একটা বিশাল অর্জন হবে।
শফিকুল আলম

প্রতিবছর ৫০ হাজার নারী ও শিশু রান্নাঘরের ধোঁয়াজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করছে। আমাদের এক হিসাব থেকে জানি, এর মধ্যে ৩২ হাজার শিশু ও ১৮ হাজার নারী।
বাংলাদেশের নারী ও শিশুদের একটা বড় সময় রান্নাঘরে কাটাতে হয়। গ্রামে সাধারণত তিনবেলা রান্না হয়। অদূর ভবিষ্যতে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় আছে বলে মনে হয় না। মা রান্নাঘরে থাকেন, তাঁর সঙ্গে ছোট শিশুরাও থাকে। এর ফলে মা ও শিশুরা শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। এর থেকে উত্তরণের জন্যই উন্নত চুলা তথা বন্ধুচুলা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
বাংলাদেশ সরকারেরও একটা দেশীয় কর্মপরিকল্পনা আছে। এ পরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তিন কোটি পরিবারের চুলা উন্নত চুলায় পরিণত হবে। এ কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা জিআইজেড ও বন্ধু ফাউন্ডেশনের অংশীদার হই।
প্রথম পর্যায়ে দেশের আটটি জেলায় ৪৫ হাজার চুলা দিয়েছি। বিভিন্ন সংস্থা মিলে মাত্র পাঁচ লাখ চুলা দেওয়া হয়েছে। আমরা এবার বন্ধু ফাউন্ডেশনের সঙ্গে ১ হাজার ১০০ স্কুলে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তানদের কথা শুনতে মা-বাবা বাধ্য হন। বন্ধুচুলার ফলপ্রসূ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য অনেক কর্মশালা করতে হবে। আর রক্ষণাবেক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
শাহিদা খাতুন

এই চুলা ব্যবহার করে এখন আমি অনেক ভালো আছি। সাধারণ চুলায় রান্না করার সময় অনেক ধোঁয়া হতো। সন্তানদের শ্বাসকষ্ট হতো। কাশি হতো। ঘরের টিন নষ্ট হয়ে যেত। প্রতিবছর ১০ হাজার টাকার টিন পরিবর্তন করতে হতো।
বন্ধুচুলা ব্যবহার করার ফেল কোনো সমস্যা হয় না। আরামে রান্না করতে পারি। রান্নাঘরে কোনো ধোঁয়া হয় না। জ্বালানি কাঠ কম লাগে। আমার ঘর পরিষ্কার থাকে।
এ চুলার দাম কোনো বিষয় নয়। এক বছর আগে চুলা নিয়েছি। আমার দেখাদেখি আরও অনেকে এ চুলা নিয়েছে। এ চুলা নেওয়ার পর এখন আর রান্না করতে কষ্ট হয় না। মনের আনন্দে রান্না করতে পারি।
মো. খালেদ

আমি প্রথমে রংপুরে বন্ধুচুলার কাজ করতাম। ওখানে হোটেলে, বাসাবাড়িতে অনেক চুলা দিয়েছি। এ চুলার দ্বারা মানুষ অনেক উপকৃত হয়েছে। আস্তে আস্তে সবাই বন্ধুচুলার উপকারের কথা জানতে পারে। ঢাকা থেকে অনেকে রংপুরে আমার কাছে চুলা আনতে যায়। পরে রংপুর থেকে ঢাকার সাভারে চলে আসি।
আমার কাজের এলাকায় বড় বড় হোটেল, কমিউনিটি সেন্টার, চানাচুরের কারখানাসহ অনেক জায়গায় এ চুলা দিয়েছি। এ চুলা ব্যবহার করে সবাই খুব খুশি। একটা হোটেলে মাসে ২০০ থেকে ৩০০ মণ খড়ি লাগে। এখন তাদের অর্ধেকেরও কম লাগছে।
আমি বন্ধু ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। একটু খেয়াল করলেই ছোট ছোট সমস্যা ঠিক করা যায়। হয়তো পাইপ জ্যাম হলো, খুব সামান্য সমস্যা। এমন সব সামান্য সমস্যার কারেণ অনেকে চুলা বাদ দিয়ে দেন। যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁদের উচিত দ্রুত সমস্যা ঠিক করে দেওয়া।
সুচিত্রা হাজং

বন্ধুচুলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারেন। তাঁরা যদি নারী রোগীদের বলেন, ধোঁয়ার ফলে এই সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে। তাই ধোঁয়া এড়ানোর জন্য উন্নত চুলা ব্যবহার করা উচিত।
তা ছাড়া উন্নত চুলায় জ্বালানি খরচ অর্ধেকের বেশি কমে যায়। আবার স্কুলে যেসব শিক্ষিকা আছেন, তাঁরা নিজেরাও রান্না করেন। এ জন্য তাঁদের অনেক সমস্যা হয়, কষ্ট হয়। ফলে তাঁরা নিজেরা উন্নত চুলা ব্যবহার করতে পারেন। শিক্ষার্থীদের এর উপকার সম্পর্কে বলতে পারেন।
আমরা, নারীরা রান্নাঘরের ব্যবস্থাপক। আমরা যদি জ্বালানি খরচ কমাতে চাই, সন্তানদের ভালো রাখতে চাই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ চাই, ঝামেলামুক্ত রান্না চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের সবার বন্ধুচুলা বা উন্নত চুলা ব্যবহার করতে হবে। এটা নারীর ক্ষমতায়নেও অবদান রাখছে।
শফিকুল ইসলাম

২০০৭ সালে আমি উন্নত চুলা নিয়ে কাজ করি। অনেকে ব্যবহার করতে অস্বস্তি বোধ করে। তারা বলে যে আগুন দেখা যায় না। তাপ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তারা বুঝতে পারে না। এমন কিছু সমস্যা দেখা যায়। এমনকি আমার মা-ও একই কথা বলেন।
২০০৩ সালে যখন বাড়িতে বাড়িতে স্যানিটেশন দিয়েছি, তখনো অনেকে বলেছে, এত ছোট ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসে। গ্রামাঞ্চলে এমন কিছু বিভ্রান্তি থাকেই। আমার ইউনিয়ন পরিষদে যাঁরা সরকারের সুবিধাভোগী, তাঁদের বাধ্য করেছি চুলা ব্যবহার করতে।
এভাবে এক থেকে দুই বছর ব্যবহারের পর তাদের অভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে। এখন আমার এলাকায় আট হাজারের বেশি চুলা দিয়েছি। প্রধান সমস্যা রক্ষণাবেক্ষণ। রক্ষণাবেক্ষণ করলে এ চুলা নষ্ট হবে না, চলতেই থাকবে।
সাধারণ চুলার ধোঁয়ায় আমাদের ফলমূলের ফলন কমে গেছে। স্বাদ নষ্ট হয়েছে। উন্নত চুলায় কম জ্বালানি লাগে বলে কম ধোঁয়া নিঃসরিত হয়। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমে যায়। সারা দেশে উন্নত চুলার ব্যাপক ব্যবহারের জন্য জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
সালামত খন্দকার

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি ফ্যাক্টশিট প্রকাশ করেছে। এখানে ধোঁয়াজনিত সমস্যার কথা বলা হয়েছে। সমস্যাগুলো হলো চোখ জ্বালাপোড়া, শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার, ফুসফুসের রোগ, রক্তে অক্সিজেন বহনের ক্ষমতা কমা ইত্যাদি। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চারটি বিশেষ রোগের কথা বলেছে। যেমন নিউমোনিয়া, স্ট্রোক, স্কিমিক হার্ট ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার। ৫০ শতাংশ শিশুর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণ অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ।
এটা ছাড়াও অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণে ৩৪ শতাংশ স্ট্রোক, ২৬ শতাংশ হৃদ্রোগ, ২২ শতাংশ শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, হাঁপানি ও ৬ শতাংশ লাং ডিজিজ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমাদের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ নারী গড়ে প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা রান্নাঘরে থাকেন। এভাবে প্রতিনিয়ত দূষিত বায়ু গ্রহণ করছেন তাঁরা। ফলে একসময় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
গ্রামের নারী ও শিশুদের শরীরে প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর উপাদান ঢুকছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হতে পারে বন্ধুচুলা। পরিবারে নারী ও শিশুদের ধোঁয়া থেকে নিরাপত্তা দিতে পারে বন্ধুচুলা।
মাহফুজা খানম

প্রচলিত চুলায় নারীরা অনেক জ্বালানির অপচয় করেন। উন্নত চুলায় আগে থেকে সবকিছু প্রস্তুত করে রান্না করতে হয়।
উন্নত চুলার বড় সমস্যা হলো এর রক্ষণাবেক্ষণ। একজন গৃহিণীর চুলা কিছুটা ফেটে গেছে। বললাম, একটু কাদামাটি দিয়ে লেপে নেবেন। তিনি বললেন, যিনি চুলা দিয়েছেন তিনি এটা করবেন। এই যদি মানসিকতা হয়, তাহলে রক্ষণাবেক্ষণ কীভাবে হবে?
আমরা বিভিন্ন জেলায় কর্মী তৈরি করি। এনজিওগুলোর সঙ্গে কাজ করি। জিআইজেডের খালেকুজ্জামান খুব ঘনিষ্ঠভাবে আমাদের সঙ্গে কাজ করেন। চুলাকে কীভাবে টেকসই করা যায়, সে ব্যাপারে তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর উদ্যোগগুলো প্রশংসনীয়।
উন্নত চুলা ব্যবহার করলে দেশ ও জাতি যে উপকৃত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বছরে ১৫০ কোটি মণ জ্বালানি কাঠ লাগে। এই উন্নত চুলায় ৭০ কোটি মণ কাঠ কম লাগবে। এতে দেশের বনভূমি, গাছপালা রক্ষা পাবে।
এ কাজের সঙ্গে জড়িত অনেকে তাঁদের জীবনে ব্যাপক সফলতা এনেছেন। এখন সবাই মিলে কীভাবে এ কাজকে এগিয়ে নেওয়া যায়, সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
কে এম হোসেন

আমি মনে করি, এসব কাজে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। দেশে তিন কোটি চুলা লাগবে। এর সামান্য অংশ এ পর্যন্ত বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে।
সরকার প্রতি উপজেলায় সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সাত কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এখন ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে গ্রামে সৌরশক্তি ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। কোনো একটি মন্ত্রণালয় বা সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে বন্ধুচুলা সম্প্রসারণের বিষয়টি যুক্ত থাকলে আমরা সম্পৃক্ত হতে পারি।
এলাকার মানুষ যাতে এটা ব্যবহার করে, সে ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে পারি। মানুষ যেন প্রচলিত চুলা ব্যবহারের পুরোনো অভ্যাস পরিবর্তন করে, সে ব্যাপারে কাজ করতে হবে। রান্নার কাজটি মায়েরা করেন। তাঁরা এটাকে তাঁদের ক্ষমতায়ন মনে করেন। সাধারণত তাঁদের বয়স বেশি থাকে। তাঁদের অভ্যাস পরিবর্তন করা কিছুটা কঠিন।
আমরা চাই সব সময় নতুন কিছু করতে, যার মাধ্যমে এলাকার মানুষ উপকৃত হবে। এই চুলার ব্যাপারে আমার এলাকার মানুষকে সচেতন করতে চাই, যেন তারা এই চুলা ব্যবহার করে উপকৃত হয়।
ইজাজ হোসেন

অনেক দিন থেকে বন্ধুচুলা সম্পর্কে জানি। ১৯৯৫ সাল থেকেই সায়েন্স ল্যাবরেটরি উন্নত চুলা তৈরি করে আসছে। কিন্তু কাজ খুব বেশি এগোয়নি। জ্বালানির সংকট আগেও ছিল, এখনো আছে।
ধারণা অনুযায়ী, মানুষ এ চুলার প্রতি আশানুরূপ সাড়া দেয়নি। প্রধান সমস্যা হলো, মানুষ এ চুলা ব্যবহার করে অভ্যস্ত নয়। অভ্যাসের পরিবর্তন করাও কঠিন। সাধারণ চুলা ও এ চুলার মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।
এ চুলা চারদিক থেকে বন্ধ থাকে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য অক্সিজেন জ্বালানি ভালোভাবে পুড়িয়ে ফেলে। ফলে প্রায় ৪০ শতাংশ জ্বালানি বেঁচে যায়।
২০২১ সালের মধ্যে দেশের সব মানুষকে উন্নত চুলা দেওয়া কঠিন। যদি ২৫ শতাংশ মানুষকেও দেওয়া যায়, সেটা হবে অনেক বড় সফলতা। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে পেঁৗছানোর জন্য একটা কার্যকর পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।
সুজিত চৌধুরী

২০১১ সালে বন্ধুচুলার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। জনাব খালেক তখন আমাকে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বন্ধুচুলার ব্যাপক প্রয়োজন হবে। আমি তখন জার্মান দূতাবাসে চাকরি করি। জার্মান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বন্ধুচুলা নিয়ে আলোচনা হয়।
খালেকুজ্জামান বন্ধুচুলাকে বাজারজাতের উদ্যোগ নিলেন। জার্মান প্রকল্প পরিচালক এটা গুরুত্ব দিলেন। বাজারজাতকরণের এই উদ্যোগকে একটি জার্মান–বাংলাদেশ মডেল হিসেবে দেখা চলে।
আমাদের জ্বালানি সংকট বহুমাত্রিক। বন্ধুচুলার মাধ্যমে আমরা একটি বিকল্প ধারণা তৈরির চেষ্টা করছি। এ ধারণা দেশের সব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।
সব মানুষ যদি উন্নত চুলা ব্যবহার করে, সেটা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের কল্যাণ বয়ে আনবে।
কামরুল ইসলাম চৌধুরী

বন্ধুচুলাকে পরিচিত করতে হলে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। একটি সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন। কারণ, মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তন করতে হবে।
২০২১ সালের মধ্যে সব মানুষকে বন্ধুচুলা দিতে হলে এর ব্যাপক প্রচারে জাতীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। নব্বইয়ের দশকে স্যানিটেশনের প্রচারের সঙ্গে জাতীয় নেতারা সম্পৃক্ত ছিলেন। গণমাধ্যমে প্রচার ছিল। স্থানীয় সরকার, জেলা-উপজেলা প্রশাসন, পৌরসভাগুলো এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল। এসব উদ্যোগের ফলে আজ বাংলাদেশ প্রায় শতভাগ স্যানিটেশনে পৌঁছাতে পেরেছে।
বন্ধুচুলার ক্ষেত্রে ঠিক একই রকম কাজ করতে হবে। সঙ্গে গণমাধ্যমকে কাজে লাগাতে হবে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের বন্ধুচুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। এদের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হবে।
দেশের নেতৃস্থানীয় বরেণ্য ব্যক্তিদের বন্ধুচুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাঁদের কাজে লাগাতে হবে। এভাবে আমরা যদি আগামী কয়েক বছরে ২৫ শতাংশও বন্ধুচুলা দিতে পারি, তাহলে পরের পর্যায়ে আরও অনেকখানি এগোতে পারব। এ কাজের জন্য একটা গঠনমূলক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। আর একটি-দুটি প্রতিষ্ঠান এ কাজ করলে হবে না। আরও অনেক প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
ফজলে রাব্বি সাদেক আহমেদ

প্রতিটি বস্তু ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হয়। এ চুলার কিছু সমস্যা রয়েছে। তাই এত দিনেও এর কার্যকর ব্যবহার বাড়েনি। অনেক সময় দেখা যায়, চিমনি বসানোর ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ে। মানুষ মনে করে, এটা তো ভালো নয়, পানি পড়ে। পাশের মানুষ এটা দেখে আর এ চুলা ব্যবহার করতে চায় না।
শিশুরা চিমনিতে হাত দিলে গরম লাগে। হাত পুড়ে যায়। মানুষ মনে করে, আরে! এটা তো ভালো নয়। শিশুদের হাত পুড়ে যায়। কোথাও কোথাও চিমনি এমনভাবে বসানো হয় যে চালে আগুন ধরে যায়। এটা তো ভয়ংকর বিপদের দিক। এটা দেখে কোনো মানুষ কি উন্নত চুলা ব্যবহার করতে চাইবে?
অনেকে ভেতরের ছাঁকনি, চুলার পাশের অক্সিজেন প্রবেশের ছিদ্র বন্ধ করে দেয়। এভাবে ছাঁকনি সরিয়ে ফেললে, ছিদ্র বন্ধ করে দিলে চুলার কার্যকারিতা কমে যায়। তখন মানুষ মনে করে, এ চুলায় কাজ হয় না। এসব সেবা ঠিকমতো না দেওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। একবার নেতিবাচক ধারণা তৈরি হলে সেটা সহজে পরিবর্তন করা যায় না। চুলা দেওয়ার পর এর পরিচর্যার বিষয়টিতে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে।
আমরা দিয়েছি পাঁচ লাখ চুলা, দিতে হবে পাঁচ কোটি। ব্যবহারকারীদের মধ্যে যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে, তেমনি চুলার মধ্যেও বৈচিত্র্য আনতে হবে।
আইনুন নিশাত

উন্নত চুলা, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট—এসব নিয়ে একসময় কাজ করেছি। উন্নত চুলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা আসেনি। কেন আসেনি? এটাই খুঁজে বের করতে হবে।
এ সমস্যা সমাধানের জন্য পুরুষদের রান্নাঘরে পাঠাতে হবে। পুরুষেরা রান্না করেন না। রান্নাঘরের দুর্গতি তাঁরা বোঝেন না। বাংলাদেশের অন্যতম দূষিত জায়গা হলো রান্নাঘর। বর্ষাকালে একজন নারী ভেজা কাঠ ধরানোর জন্য চোঙায় ফুঁ দিচ্ছেন। তাঁর চারপাশ থেকে ছাই, ময়লা উড়ছে। এর থেকে দূষিত জায়গা আর হতে পারে না।
একজন নারীর রান্না করতে চোখ লাল হয়ে যায়। নারীদের এই চোখ লাল হয়ে যাওয়া আগে বন্ধ করতে হবে। পাঁচ কোটি পরিবারের মধ্যে মাত্র তিন বা পাঁচ লাখ পরিবারকে বন্ধুচুলা দেওয়া হয়েছে।
প্রয়োজনের তুলনায় এটা অনেক কম। বাংলাদেশে স্যানিটেশন, ওরস্যালাইন, সোলার প্যানেল ইত্যাদির জন্য প্রচার হয়েছে। এগুলো মানুষ গ্রহণ করেছে।
উন্নত চুলা ব্যবহারের জন্য প্রচারের একটা ধরন বের করতে হবে। তার আগে প্রয়োজন চুলা যাতে ভালোভাবে কাজ করে, সেটা নিশ্চিত করা। একটা ভালো কাজ ইতিমধ্যে করা হয়েছে, তা হলো উদ্যোক্তা সৃষ্টি। উদ্যোক্তারা নিজেরা স্বাবলম্বী হবেন।
শওকত আলী

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের পরিবেশের জন্য এ চুলা অনেক সহায়ক। তা ছাড়া এ চুলা জ্বালানিসাশ্রয়ী। তাই ভবিষ্যতে এটি জ্বালানি–সংকট মেটাতে সহায়ক হতে পারে।
মানুষের মধ্যে এ চুলার প্রচার প্রয়োজন। মানুষকে জানানো প্রয়োজন। আজকাল এই গোলটেবিল আলোচনার মধ্য দিয়ে অনেক মানুষ জানতে পারবে। স্থানীয় সরকার এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
এখানে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার আছেন। নারী প্রতিনিধিও আছেন। তাঁরা সবাই যদি এ চুলার ব্যাপারে সচেতন হন এবং মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন, তাহলে এ চুলার প্রসার আরও বাড়বে।
যেভাবে সবাই কাজ করছি, তা করে যেতে হবে। সফলতা আসবেই। আমার দিক থেকে যা যা করা সম্ভব, আমি সেটা করব।
আব্দুল কাইয়ুম: গ্রামের নারীদের প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা রান্নাঘরে থাকতে হয়। ধোঁয়ায় নারীদের রান্না করতে অনেক কষ্ট হয়। তাঁরা ধোঁয়াজনিত রোগে আক্রান্ত হন। এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি।
এ জন্য আমাদের উন্নত চুলা ব্যবহার করতে হবে। কীভাবে গ্রামের প্রতিটি রান্নাঘরে উন্নত চুলা দেওয়া যায়, সে জন্য কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেবে বলে আশা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
যাঁরা অংশ নিলেন
শওকত আলী : মাননীয় সাংসদ ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
আইনুন নিশাত : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
মাহফুজা খানম : পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব ফুয়েল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, সায়েন্স ল্যাব
ফজলে রাব্বি সাদেক আহমেদ : প্রজেক্ট ডাইরেক্টর, ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রজেক্ট, পিকেএসএফ
কে এম হোসেন : উপজেলা চেয়ারম্যান, ফরিদপুর সদর
শফিকুল ইসলাম : ইউপি চেয়ারম্যান, বিটতারা ইউনিয়ন, টাঙ্গাইল
ইজাজ হোসেন : অধ্যাপক, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বুয়েট
সালামত খন্দকার : অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, পাবলিক হেলথ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
কামরুল ইসলাম চৌধুরী : সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব
শফিকুল আলম : ওয়াটার স্যানিটেশন ও হাইজিন বিভাগ, ইউনিসেফ, বাংলাদেশ
খালেকুজ্জামান : ইঞ্জিনিয়ার, সিনিয়র অ্যাডভাইজর, জিআইজেড,বাংলাদেশ
সুজিত চৌধুরী : সদস্য, বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশন
আবি আবদুল্লাহ : উপপরিচালক, বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট
সুচিত্রা হাজং : ম্যানেজার, কমিউনিকেশনস অ্যান্ড স্পেশাল ইভেন্টস
মো. খালেদ : বন্ধুচুলা, পার্টনার, সাভার, ঢাকা
শাহিদা খাতুন : ব্যবহারকারী, বন্ধুচুলা, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো