বরাদ্দ চাই, চাই ব্যয় সক্ষমতাও

স্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুল বাজেট, বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা এবং বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার বিষয়ে স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন এবং অর্থ ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে আলোচনায় আসছে।

স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের বিষয়টিকে মোটা দাগে দুই ভাগে আলোচনা করা যেতে পারে: স্বাস্থ্য খাত কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ পাচ্ছে এবং বরাদ্দকৃত অর্থ তারা কীভাবে ব্যয় করছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ১৯৯৮ সালে স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার শুরু করে। সেই সময় পাঁচ বছর মেয়াদি স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাত প্রকল্পের (১৯৯৮-২০০৩) মোট বাজেট ছিল ১১,৫২০ কোটি টাকা। বর্তমানে চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত প্রকল্পের (২০১৭-২২) মোট বাজেট ১,১৫,৪৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ২০ বছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। সময়ের সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দ বৃদ্ধি পেলেও পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশের জন্য এ বাজেট অপ্রতুল।

রুমানা হক

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস ২০১৭–এর তথ্যমতে, এ দেশে স্বাস্থ্য খাতে জনপ্রতি ব্যয় মাত্র ৩৭ মার্কিন ডলার। এই ব্যয়ের সিংহভাগ (৭৪%) জনগণ নিজেই বহন করে। বাংলাদেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৬-২০) স্বাস্থ্য খাতে জনপ্রতি ৫৪ মার্কিন ডলার ব্যয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, যা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে জাতীয় বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাত সব সময় কম অগ্রাধিকার পায়। বাংলাদেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৬-২০) উল্লেখিত স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ১ দশমিক ১২ শতাংশ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত আদর্শ মান ৫ শতাংশ। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত জাতীয় অগ্রাধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলিতই থেকে গেছে।

বাজেট বক্তৃতা থেকে দেখা যায়, ২০২১ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে, যা ১৩টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এককভাবে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য এ বছরের জাতীয় বাজেটের মাত্র ৫ দশমিক ১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রসঙ্গে অনেক সময় বলা হয় যে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় করতে পারে না, তাই অতিরিক্ত বরাদ্দের বিষয়টি যৌক্তিক নয়। সে ক্ষেত্রে এটি ভেবে দেখা প্রয়োজন যে কেন বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছে না। বিলম্বে অর্থ ছাড়, জটিল ক্রয়প্রক্রিয়া, অর্থ ব্যয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, পরিকল্পনা প্রণয়নে বিলম্ব, পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়নে দক্ষতার অভাব অর্থ ব্যয়ের প্রক্রিয়াকে আরও বিলম্বিত করে। এসব সমস্যা চিহ্নিত করে, তা দূরীকরণের ব্যবস্থা না নিয়ে স্বাস্থ্য খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি খাতে কম বাজেট বরাদ্দ দেওয়াটা আসলে কতটা যুক্তিযুক্ত, সেটা নীতি প্রণয়নকারীদের ভেবে দেখা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে ভবিষ্যতে ক্রমান্বয়ে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট জিডিপির ৩-৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

সরকারি হাসপাতালগুলো এখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেবা দিয়ে থাকে। জরুরি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালগুলো এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ এবং কন্ট্রাক্ট আউট/ইন করে সেবা দেওয়া যেতে পারে।

তবে শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি করলে হবে না, বাজেটের যথাযথ ব্যবহার এবং অর্থ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে রাজস্ব বাজেট বরাদ্দ করা হয়। একটি হাসপাতালের অন্তর্বিভাগের সক্ষমতার ভিত্তিতে, অর্থাৎ কতগুলো বেড আছে এবং কতজন স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, সেই হিসাবে। এই প্রক্রিয়ায় বাজেট বরাদ্দের সময় একটি এলাকার মোট জনসংখ্যা, তাদের স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় আনা হয় না। ফলে চাহিদা ও অর্থ বরাদ্দের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য থাকে না।

বর্তমান বাজেট ব্যবস্থাপনায় হাসপাতালের বহির্বিভাগের জন্য কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয় না। অথচ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বহির্বিভাগে দৈনিক বিপুলসংখ্যক রোগী সেবা নিয়ে থাকেন। জেলাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন নির্ণয় এবং সে মোতাবেক বাজেট বরাদ্দের জন্য তাই জেলাভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার বিন্যাসকে মূল্যায়ন করে উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় ও কেন্দ্রীয় তাদের যথাযথভাবে ক্ষমতায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

সরকারি হাসপাতালগুলো এখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেবা দিয়ে থাকে। জরুরি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালগুলো এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ এবং কন্ট্রাক্ট আউট/ইন করে সেবা দেওয়া যেতে পারে।

বাজেট বরাদ্দে জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত এবং জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাস্থ্য বাজেট প্রস্তুত করা উচিত। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যবিধি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য মনোযোগ এবং অতিরিক্ত বিনিয়োগ করার প্রয়োজন রয়েছে। জনগণকে স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করতে এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে শারীরিক দূরত্বসহ অন্য স্বাস্থ্যবিধি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থাগুলো মেনে চলতে কমিউনিটি বা এলাকাবাসীকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো উন্নয়নে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে জনগণকে সম্পৃক্ত করা এবং তাদের বাজেট–সংক্রান্ত সঠিক তথা দেওয়া প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য খাতে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অর্থায়নে একটি দুর্বলতা হলো, ১৩টি মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অর্থ ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়ন ও পরিকল্পনা প্রণয়নে দাতা সংস্থাগুলোও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কোভিড-১৯ মোকাবিলাতেও আমরা দেখেছি যে তারা অতি দ্রুত সময়ে সরকারের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। দাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে অনেকে ‘পুল ফান্ড’–এর মাধ্যমে অর্থায়ন করে, আবার অনেকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমেও অর্থায়ন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে দাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে এবং মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দাতা সংস্থাগুলোর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অর্থায়নে সমন্বয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই বিনিয়োগের বিষয়টি যথাযথভাবে বিবেচনা করতে হবে।

আমাদের দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিগত দিনগুলোয় বেসরকারি হাসপাতাল ও পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, যেটা একদিকে ভালো, জনগণ বেশি খরচ করে হলেও স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক যে দুর্যোগের সময় ব্যক্তি খাতের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো জনগণের প্রয়োজনে স্বাস্থ্যসেবায় যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেনি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও জনবহুল দেশে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা বিবেচনায় বেসরকারি হাসপাতাল ও পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোকে বিশেষ প্রয়োজনে কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে যথাযথভাবে সংযুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও নীতিমালা প্রস্তুত করা প্রয়োজন।

শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি করলে হবে না, বাজেটের যথাযথ ব্যবহার এবং অর্থ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে রাজস্ব বাজেট বরাদ্দ করা হয়।

স্বাস্থ্য খাতে পরিকল্পনা, বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আরেকটি দূর্বলতা হলো অর্থ ব্যবস্থাপনায় সঙ্গে জড়িতদের অদক্ষতা। ক্রয় ও সংগ্রহ পদ্ধতিসহ অর্থ ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য খাতে একটি দক্ষ জনবল তৈরির বিকল্প নেই, সেই সঙ্গে বাজেট তদারকির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি জেলায় রাজস্ব এবং উন্নয়ন বাজেট থেকে কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে এবং তার বিপরীতে কী পরিমাণ ব্যয় হচ্ছে—এটি নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার কোনো পদ্ধতি বর্তমানে নেই। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলেও সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি সংস্থা রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এ কারণে একদিকে যেমন বাজেট তৈরিতে সমন্বয়হীনতা তৈরি হয়, অন্যদিকে সার্বিকভাবে একটি জেলায় স্বাস্থ্য খাতে কী পরিমাণ ব্যয় হচ্ছে—বরাদ্দকৃত অর্থ প্রকৃত অর্থে ভোক্তার হাতে পৌঁছাচ্ছে কি না বা কী পরিমাণ পৌঁছাচ্ছে; মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য স্বাস্থ্য খাতে কী পরিমাণ বরাদ্দ ও ব্যয় হচ্ছে, এ–সংক্রান্ত তথ্য নিয়মিতভাবে সংগ্রহ এবং তা নিরীক্ষণ করা সম্ভব হয় না। বাজেট তদারকির জন্য তাই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তথ্যপ্রবাহকে সহজ করতে হবে।

সফল টিকাদান কর্মসূচি, মাতৃমৃত্যুর হার, শিশুমৃত্যুর হার কমানোসহ স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। কিন্তু নতুন নগরায়ণ, বয়স্ক জনসংখ্যার বৃদ্ধি, অসংক্রামক রোগ এবং ডেঙ্গু, কোভিড-১৯, যক্ষ্মাসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে ভবিষ্যতে বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে উন্নত মানের স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে না। সরকারকে তাই এখনই স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন এবং অর্থ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

ড. রুমানা হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, আর্ক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক