কৃষিতে সাফল্য
বরিশাল এখন সত্যিই শস্যভান্ডার
করোনাকালে সারা বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে নানামুখী উদ্বেগের মধ্যেও বরিশাল বিভাগে এবার আমন, বোরো, আউশ—তিন ফসল মিলিয়ে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন অতিরিক্ত চাল উৎপাদিত হয়েছে। পাশাপাশি চলতি মৌসুমে ২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি গমও উৎপাদিত হয়েছে এই বিভাগে।
এককালে বরিশালকে বলা হতো বাংলার শস্যভান্ডার। বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি ও আমন ধানের জন্য এই খ্যাতি ছিল। কিন্তু আমন তোলার পর বছরের সাত মাস এসব জমি পতিত থাকায় এ অঞ্চলের কৃষি ছিল একমাত্র আমননির্ভর। ফলে ধানের উৎপাদন বাড়েনি। একই সঙ্গে এ অঞ্চলের কৃষকেরা আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির ব্যাপারেও ছিলেন অনাগ্রহী। এর ওপর ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর ঘন ঘন বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এ অঞ্চলের কৃষকেরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
তবে এমন বিপর্যয় ঠেকিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে কৃষকেরা নিজেদের উদ্যোগেই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগে উদ্যোগী হন। শুধু আমন নয়, জমির বহুমুখী ব্যবহার শুরু করেন। এর প্রথম ধাপ শুরু হয় আউশ আবাদের ব্যাপক বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে। এরপর তা সম্প্রসারণ হয় বোরো এবং অন্যান্য ফসল উৎপাদনের দিকে। এই প্রচেষ্টার ফল মিলেছে চলতি মৌসুমে।
করোনাকালে সারা বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে নানামুখী উদ্বেগের মধ্যেও বরিশাল বিভাগে এবার আমন, বোরো, আউশ—তিন ফসল মিলিয়ে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন অতিরিক্ত চাল উৎপাদিত হয়েছে। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) এই বিভাগে তিন ফসল মিলিয়ে চাল উৎপাদিত হয়েছিল ২৮ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০২০-২০২১) তা বেড়ে হয়েছে ৩১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ মেট্রিক টন।
খরা, লবণাক্ততা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে দক্ষিণাঞ্চলে কয়েক বছর ধরে খাদ্য উৎপাদনের এই অগ্রগতিতে আপ্লুত কৃষি বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বব্যাপী যখন খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে, সেখানে বরিশালের কৃষকেরা করোনা ও জলবায়ুর নানা অভিঘাত মোকাবিলা করে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছেন। ৯৭ লাখ ১৪ হাজার ৫৬ জনসংখ্যা অধ্যুষিত বরিশাল বিভাগে বর্তমানে খাদ্যের চাহিদা ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ১৬৮ মেট্রিক টন, যা মিটিয়ে ১৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি খাদ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এ অঞ্চলের কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, প্রযুক্তিকে গ্রহণ এবং জমির বহুমুখী ব্যবহারে উদ্যোগী হওয়ায় এই অর্জন সম্ভব হচ্ছে। চাল উৎপাদনের পাশাপাশি চলতি মৌসুমে ২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি গমও উৎপাদিত হয়েছে এই বিভাগে, যা খাদ্য উৎপাদনে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) চলতি বছরের গত ৫ মে ‘নিউ গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২০ সালে ৫৫টি দেশ তীব্র খাদ্যসংকটে পড়েছে। জনসংখ্যার হিসাবে তা সাড়ে ১৫ কোটি। জনসংখ্যার হিসাবে ২০১৯ সালের তুলনায় ২ কোটি বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে। এই সংকট দিন দিন আরও বাড়ছে।
তারা বলছে, যুদ্ধ, সহিংসতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তা আগে থেকেই ঝুঁকির মুখে ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারি। ২০২১ সালে এই সংকট আরও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর মধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পথ সুগম হচ্ছে। বরিশাল অঞ্চলে আগে বোরো আবাদ ছিল খুবই সীমিত। গত কয়েক বছরে বোরোর আবাদ ব্যাপক বেড়েছে।
বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরিশালের ছয় জেলায় বোরো উৎপাদন হয়েছিল ৫ লাখ ৪১ হাজার ৭৫৪ মেট্রিক টন। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে বোরো চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রতি হেক্টরে ৪ দশমিক ৩ মেট্রিক টন ধরে ৭ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু আবাদ বেশি এবং ফলন ভালো হওয়ায় এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদন হয়েছে ৭ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন চাল।
বরগুনার আমতলী উপজেলার আঠারোগাছিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম গাজীপুর গ্রামের ফোরকান মিয়া বলেন, ‘যুগের পর যুগ একটি ফসল করে আমরা ধুঁকছিলাম। ধান উৎপাদনে যে খরচ, তাতে আসলই ওঠে না। লাভ তো দূরের কথা। কিন্তু একার নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য বদলে নেমেছি। এবার প্রথম দুই একরে বোরো আবাদ করেছিলাম। ফলন ভালো হয়েছে এবং দামও ভালো পাওয়ায় লাভের মুখ দেখেছি।’
পটুয়াখালী সদর উপজেলার ডিবুয়াপুর গ্রামের কৃষক নুরু খান বলেন, ‘এখন নিজেদের বাঁচার পথ নিজেই করতে হবে। সেই জন্য জমিকে আর পতিত রাখতে চাই না। আমন, আউশ, বোরো এখন তিন ফসলই করছি।’
ওই দুই জেলার কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, কৃষকদের এমন দৃঢ় মানসিকতা সত্যি মুগ্ধ করার মতো। কৃষকেরা জেগে উঠেছেন, এটা ইতিবাচক।
বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই বিভাগে আমন, আউশ, বেরো মিলিয়ে প্রায় ২৭ লাখ মেট্রিক টন চালের উৎপাদন হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ধারাবাহিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে আমনে বেশ ক্ষতির পরেও আগের বছরের চেয়ে উৎপাদন ১ লাখ মেট্রিক টন বৃদ্ধি পেয়ে তিন মৌসুম মিলিয়ে বিভাগে প্রায় ২৮ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছিল। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে সেই উৎপাদন সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টনের বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ মেট্রিক টন। এর মধ্যে এবার আমন উৎপাদন হয়েছে ১৭ লাখ ৯৪ হাজার ৩৭০ মেট্রিক টন, আউশ ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৫ মেট্রিক টন এবং বোরো ৭ লাখ ১৪ হাজার ৮১৩ মেট্রিক টন।
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের বরিশালের অতিরিক্ত পরিচালক মো. তাওফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলার শস্যভান্ডার হিসেবে বরিশাল অঞ্চলের পুরোনো খ্যাতি আবার ফিরতে শুরু করেছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রতিবছর এই বিভাগে চাল ও অন্য শস্যের উৎপাদন বেড়েই চলেছে। কৃষকদের প্রচেষ্টা এবং কৃষি বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ, নতুন নতুন প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, সুবিধা ও প্রণোদনা বৃদ্ধির কারণে এই সাফল্য অর্জিত হচ্ছে।