বর্গফুটপ্রতি ১৫০০ টাকায় ফ্ল্যাট: আপনার টাকা যেভাবে ‘কালো’ হয়

কালো টাকা
প্রতীকী ছবি

ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনতে গেলে এলাকাভেদে প্রতি বর্গফুটের দাম পড়বে ৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দর আরও বেশি।

অবশ্য ফ্ল্যাট কেনাবেচার ওপর কর আদায়ের ক্ষেত্রে বর্গফুটপ্রতি সর্বনিম্ন দাম দেড় হাজার টাকা। ক্রেতারা সাধারণত এ দর দেখিয়েই ফ্ল্যাট নিবন্ধন নেন। কিন্তু বাস্তবে কেনাবেচা হয় তিন গুণ, চার গুণ অথবা ১০ গুণ দামে।

ফ্ল্যাট কেনাবেচায় যে পরিমাণ অর্থ দাম হিসেবে দেখানো হয়, প্রকৃত মূল্যের বাকিটা কিন্তু কালো হয়ে যায়। ক্রেতা ও আবাসন প্রতিষ্ঠান হয় কালোটাকার মালিক। ধরা যাক, আপনি ফ্ল্যাট কিনেছেন এক কোটি টাকায়। কিন্তু দাম ৪০ লাখ টাকা দেখিয়ে নিবন্ধন নিয়েছেন। এতে বাকি ৬০ লাখ টাকা কালোটাকায় পরিণত হলো।

শুধু ফ্ল্যাট নয়, জমি কেনাবেচায় এমন ‘মৌজা রেট’ নির্ধারণ করা আছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা গতকাল বুধবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, রাজধানীর গুলশান এলাকায় জমির যে দাম দেখিয়ে নিবন্ধন করা হয়, জমির প্রকৃত দাম তার চেয়েও বেশি। কিন্তু বেশি দামে তো নিবন্ধন করানো যায় না, প্রতিটি মৌজার জন্য দাম ঠিক করে দেওয়া আছে, এর বেশি দামে নিবন্ধন করা যাবে না। সুতরাং কালোটাকা তো সেখানেই সৃষ্টি হচ্ছে; কে কালো টাকার বাইরে আছে?

মন্ত্রী আরও বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, যে ফ্ল্যাট দুই কোটি টাকায় নিবন্ধিত হচ্ছে, সেই ফ্ল্যাটের প্রকৃত দাম ১০ কোটি টাকা। ফলে সরকার বাড়তি নিবন্ধন মাশুল পাচ্ছে না। এখানেই কালোটাকা সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা শহরে যাঁর জায়গা আছে কিংবা যে ব্যক্তি জায়গা কিনেছেন, শুধু তিনিই বলতে পারবেন কত টাকায় নিবন্ধন হয়েছে এবং জমির প্রকৃত বাজারদর কত।

‘কালো’ টাকা কী, সেটাও জেনে রাখুন। আপনি যে আয় আপনার কর নথিতে প্রদর্শন করেননি, সেটাই অপ্রদর্শিত অর্থ, যা ‘কালো’ টাকা নামে পরিচিত।

মৌজা রেট কী

মৌজা রেট হলো জমি কেনাবেচায় কর আদায়ের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সর্বনিম্ন দর। মানে হলো, এর চেয়ে কম দাম দেখিয়ে কেউ জমি কেনাবেচা করতে পারবেন না।

মৌজা রেট নির্ধারণের কাজটি হয় ‘সর্বনিম্ন বাজারমূল্য বিধিমালা’ অনুসরণ করে। এ বিধিমালা অনুযায়ী, বাজারমূল্য নির্ধারণ করে একটি কমিটি। কমিটির মাধ্যমে প্রতি দুই বছর অন্তর বাজারমূল্য হালনাগাদ করা হয়। এ ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ে (২২ মাস) দলিলে উল্লেখ করা দামের (হস্তান্তর মূল্য) গড় করে নতুন বাজারদর নির্ধারণসংক্রান্ত প্রস্তাব তৈরি করা হয়। পরে মৌজা রেট চূড়ান্ত করেন নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক।

প্রথম আলোতে ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ‘অবাস্তব মৌজা রেট: রাজস্ব কমে, দুর্নীতি বাড়ে’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন বলছে, ঢাকার গুলশান সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের অধীনে মৌজা আছে ১৪টি। এ ১৪ মৌজায় ৮ ধরনের জমি আছে। মৌজা রেট অনুযায়ী, ধরনভেদে এ এলাকার ১ শতাংশ জমির দাম ১ লাখ থেকে ৫৮ লাখ টাকা। কিন্তু গুলশানের কোথাও কোটি টাকা শতাংশের নিচে জমি পাওয়া যায় না।

বর্তমান মৌজা রেট অনুযায়ী, ধানমন্ডি এলাকার ১ শতাংশ জমির সর্বনিম্ন দাম ৪৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ধানমন্ডির কোথাও এ দামে জমি বেচাকেনা হয় না।

ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট বর্গফুটপ্রতি ১৫০০ টাকা

সারা দেশে জমি ও ফ্ল্যাট হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিল নিবন্ধন করতে হয় সরকারের নিবন্ধন অধিদপ্তরের অধীন সংশ্লিষ্ট সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ে। এ নিবন্ধন অধিদপ্তরের মাধ্যমেই মৌজা রেট নির্ধারণ করা হয়।

অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের সর্বনিম্ন মূল্য ১ হাজার ৫০০ টাকা, অন্যান্য শহরে ১ হাজার ২০০ টাকা এবং মফস্বল এলাকায় ১ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

ক্রেতারা নিশ্চিতভাবেই জানেন, এ দরে কোথাও ফ্ল্যাট পাওয়া যায় না।

অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার মৌজা রেট ২০১৬ সালে শেষবারের মতো নির্ধারণ করা হয়েছিল। গত ১ জানুয়ারি থেকে নতুন মৌজা রেট কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে প্রস্তাবিত একটি মৌজা রেটও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি কার্যকর হয়নি। আগের মৌজা রেটই ২০২২ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে।

মৌজা রেট কি মানতেই হয়

মৌজা রেট মানতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আপনি দাম মৌজা রেটের চেয়ে বেশি দেখিয়ে নিবন্ধন নিতে পারেন। সমস্যা হলো, এতে কর আসবে বেশি। সেটা দিতে কতজন প্রস্তুত?

এক ব্যক্তি দিতে চাইলেই হবে না, অপর পক্ষকেও প্রস্তুত থাকতে হবে। ধরুন আপনি সততার সঙ্গে প্রকৃত মূল্য দেখিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে চান, ক্রেতা কি বাড়তি কর দিয়ে কিনতে চাইবেন? আবার আপনি প্রকৃত ক্রয়মূল্য দেখিয়ে কিনতে চান, বিক্রেতা কি সেটা মানবে? প্রকৃত দর দেখালে তো দুজনের ক্ষেত্রেই বাড়তি কর আসবে।

দেখে নেওয়া যাক, করের হার আসলে কত? জমির ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প ডিউটি দেড় শতাংশ, নিবন্ধন ফি ১ শতাংশ, স্থানীয় সরকার কর ৩ শতাংশ এবং এলাকাভেদে ১ থেকে ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর দিতে হয়। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানের জমি-ফ্ল্যাট কেনাবেচা হলে আরও ৪ শতাংশ উৎসে কর যোগ হয়।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সূত্রে জানা গেছে, ফ্ল্যাট কেনাবেচার ক্ষেত্রে এখন করহার মোট ১০ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ। মানে হলো, ৫০ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনলেন কিস্তিতে। নিবন্ধনের সময় আপনাকে দিতে হবে অন্তত পাঁচ লাখ টাকা।

দলিল লেখকেরা মনে করেন, দলিলে জমি, প্লট বা ফ্ল্যাট হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দাম কম দেখানোর পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তবে মূল কারণ নিবন্ধন ফি ফাঁকি দেওয়া।

আবাসন ব্যবসায়ীরা মনে করেন, জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচায় করের হার অত্যন্ত বেশি। তাই ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাও বেশি। অনেকে তো ফ্ল্যাট কিনে বছরের পর বছর নিবন্ধন ছাড়াই বসবাস করেন।

আরও পড়ুন

সরকার সবই জানে

জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচার ক্ষেত্রে প্রকৃত দাম যে দেখানো হয় না, তা জানে সরকার। অর্থমন্ত্রী সেটা শুধু প্রকাশ্যে বললেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমস্যাটি সমাধানে সরকারকে আগের সুপারিশ পাঠিয়েছিল। প্রকৃত বাজারদর ও মৌজা রেটের তারতম্য দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে উল্লেখ করে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেয় দুদক। চিঠিতে বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে বাজারমূল্য নির্ধারণ বিধিমালা সংশোধনের অনুরোধ করা হয়।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, এর আগে একই বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত চারটি সভা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত একটি সভায় সমস্যা সমাধানে ছয়টি সুপারিশ করা হয়েছিল। সুপারিশগুলো চিঠি দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানিয়েছে দুদক।

সুপারিশের মধ্যে রয়েছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে জমির প্রকৃত মূল্য নির্ধারণের জন্য কমিটি গঠন। কমিটি প্রকৃত বাজারমূল্য যাচাই করে প্রতিবেদন দেবে, সেই আলোকে সর্বনিম্ন বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হবে।

‘সিস্টেম’ বদলাবে কে?

বিদ্যমান সিস্টেমের কারণে মানুষ কালোটাকার মালিক হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রশ্ন হলো, ‘সিস্টেম’ বদলানোর কাজটি কার। সেটা তো সরকারেরই। দুদক সরকারকে সুপারিশ করেছে। তাহলে ‘সিস্টেম’ বদলাচ্ছে না কেন।

প্রথম আলোকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছিলেন, চলমান মৌজা রেট ব্যবস্থায় দুর্নীতির সুযোগ আছে, এটা জেনেবুঝেই ব্যবস্থাটি টিকিয়ে রাখা হয়েছে।