বর্ণাঢ্য জীবনের সরল মানুষ

শামসুজ্জামান খান (জন্ম ১৯৪০, মৃত্যু ২০২১)

নববর্ষেই বজ্রাঘাত। এক বছর ধরে কোভিড-১৯ এক এক করে নিঃস্ব করে দিচ্ছে আমাদের। বিয়োগের সে দীর্ঘ তালিকায় পয়লা বৈশাখ সকালে যুক্ত হলো শামসুজ্জামান খানের নাম।

অঙ্কের হিসাবে হয়তো বলা যাবে না যে শামসুজ্জামান খান অকালে চলে গেলেন। বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। কিন্তু বয়স তাঁর শরীরে বা মনে কামড় বসাতে পারেনি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আগপর্যন্ত আকণ্ঠ ব্যস্ততায় ডুবে ছিলেন। প্রথম আলোর ঈদসংখ্যার জন্য ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন জুলফিকার খানের লিখে যাওয়া অমূল্য কাগজপত্র। পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমান বর্গে জুলফিকার খান এক অতি

বিরল চরিত্র। জন্ম ১৭৯০ সালে। পূর্ববঙ্গীয় এই যুবকটি ইংরেজ উপনিবেশের কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রাচ্যবিদ্যা বিভাগের গ্রন্থাগারিক হয়েছিলেন। বাঙালির ইতিহাসের ভাঙাগড়ার একটি দৃশ্যপট তাঁর চোখের সামনে পাল্টে যাচ্ছিল। তাঁর কথা পরে হবে। ফেরা যাক শামসুজ্জামান খানের প্রসঙ্গে।

মানুষের মনে শামসুজ্জামান খানের বড় পরিচয় তিনি লোকচর্চার বিশেষজ্ঞ। কথা সত্য, তবে অর্ধেক। লোকচর্চার বাইরে তাঁর বিদ্যাচর্চার আরও বড় পরিসর ছিল। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন দফা তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদে ছিলেন। এই সময়টাতে বাংলা একাডেমির সক্রিয়তার লুপ্ত ঐতিহ্য অনেকটাই ফিরিয়ে এনেছিলেন। বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর সময়ে প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ভাষার বিবর্তনমূলক অভিধান, প্রমিত বাংলা ভাষার অভিধান, বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস-এর একটি খণ্ড, মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা এবং ৪ খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ জীবনী।

শামসুজ্জামান খানের একটি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ চর্চা অনেকটাই যেন সবার চোখের আড়ালে থেকে গেল। পূর্ববঙ্গে বাঙালি মুসলমানের সচেতন উন্মেষের সময়টা তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। এ ক্ষেত্রে শামসুজ্জামান খানের প্রধান দুই চর্চার বিষয় ছিল বিষাদ-সিন্ধুর অমর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন এবং মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী। এঁদের বহু রচনা তিনি পাণ্ডুলিপি থেকে প্রকাশনায় এনেছেন। মনিরুজ্জামান এছলামাবাদীর আত্মজীবন আর মীর মশাররফ হোসেন-পত্নী বিবি কুলসুমের রোজনামচা আলাদা করে উল্লেখ করার মতো। বিবি কুলসুমের লেখাটি বাঙালি নারীর আত্মোপলব্ধির অমূল্য দলিল এবং বাংলা অঞ্চলের মানবীবিদ্যায় অবশ্যপাঠ্য।

লোকবিদ্যাচর্চায় আসলে শামসুজ্জামান খানের কোনো প্রস্তুতি বা দীক্ষা ছিল না। তিনি যে এখানে এসেছিলেন, সে ইতিহাস বেদনার। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী তাঁকে ফোকলোর বিভাগে সরিয়ে দিয়েছিলেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে। এটি তাঁর জীবনের মোড় ফিরিয়ে দেয়। নিজেকে তিনি শুধু খাপ খাইয়েই নেননি; এমন কিছু পদক্ষেপ তিনি সেখানে নিলেন, যার ফল হলো সুদূরপ্রসারী। তাঁর নিজের বড় কাজ দুই খণ্ডে চন্দ্রকুমার দের অগ্রন্থিত রচনার সংগ্রহ। মাসে এক টাকা বেতনের মুদিদোকানের তুচ্ছ কর্মচারী থেকে ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক হয়ে ওঠা চন্দ্রকুমার দে আবার প্রাণ ফিরে পেলেন তাঁর হাতে।

তবে শামসুজ্জামান খানের আরও বড় ভূমিকা অন্য জায়গায়। ঢাকাকে বাংলা লোকবিদ্যাচর্চার মূল কেন্দ্র হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর আমন্ত্রণে ১৯৮৫ সালে প্রথম জাতীয় ফোকলোর কর্মশালায় লোকবিদ্যাচর্চার আন্তর্জাতিক একঝাঁক মহারথী গবেষক বাংলাদেশে এলেন বাংলা একাডেমির আতিথ্যে। যখন ফিরে গেলেন, বাংলাদেশের লোক-ঐশ্বর্যের আলোর ঝাপটায় তাঁদের হৃদয় তখন বিবশ। এর ফল ফলল বাংলাদেশে এর পরে তাঁদের ঘন ঘন আনাগোনায়; নানা সমীক্ষা, গবেষণা, প্রকাশনায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক হেনরি গ্লাসির বই আর্ট অ্যান্ড লাইফ ইন বাংলাদেশ তারই অসামান্য ফসল।

শামসুজ্জামান খানের মনের বিবর্তন ঘটেছিল তাঁর জীবনের পথরেখায় কয়েকটি উজ্জ্বল সংযোগে। তাঁর জন্ম কয়েক প্রজন্ম ধরে শিক্ষায় বিকশিত এক পরিবারে। যুবা বয়সে প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনীতিতে হয়েছিল তাঁর হাতেখড়ি। বাংলা একাডেমির ফোকলোর বিভাগে শাস্তিমূলক বদলটি হয়েছিল শাপে বর। বাংলার লোকসম্পদ তাঁকে সিক্ত করেছিল পূর্ববঙ্গের সমন্বয়ধর্মী অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। পূর্ববঙ্গের বিকাশ তাঁর ভাবনা ও গবেষণারও বিষয় হয়ে ওঠে।

শামসুজ্জামান খানের ভালোবাসাভরা গবেষণা প্রকাশের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল প্রথম আলো পত্রিকা। মীর মশাররফ হোসেনের আত্মজীবনীর অপ্রকাশিত বহু অংশ, বিবি কুলসুমের রোজনামচা, মনিরুজ্জামান এছলামাবাদীর আত্মজীবনী ছাড়াও আরও এমন বহু লেখা প্রথম আলোতে বেরিয়েছে, বাঙালি ও পূর্ববঙ্গকে ভালো করে বুঝতে হলে যার কাছে আমাদের বারবার ফিরে আসতে হবে। সে ধারাবাহিকতাতেই শেষ জীবনে জুলফিকার খানকে নিয়ে লিখতে বসেছিলেন তিনি। লিখতে যে পারলেন না, সে দুঃখ আমাদের রয়ে গেল। কিন্তু এর চেয়েও বড় পরিতাপের বিষয়, আমাদের সামাজিক ইতিহাসের একটি অজানা অধ্যায় থেকে গেল নাগালের বাইরে।

জুলফিকার খান ছিলেন শামসুজ্জামান খানের ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ, অর্থাৎ দাদার দাদার বাবা, তাঁদের পরিবারে আধুনিক শিক্ষা নেওয়া প্রথম মানুষ। ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করার পর প্রায় প্রথম পর্বেই তিনি সেখানে যোগ দেন। বাঙালির ইতিহাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ যে গুরুতর প্রভাব রাখতে শুরু করে, তার তিনি প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁর ইংরেজিতে লিখে রাখা কাগজপত্র থেকে সে সময়ের এক পূর্ববঙ্গবাসীর অভিজ্ঞতা উদ্ধারের কথা শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে হচ্ছিল প্রায় এক দশক ধরে। সময় করে উঠতে পারছিলেন না। এবার তিনি লিখতে বসেছিলেন। কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে প্রায়ই উত্তেজিত হয়ে ফোন করতেন। লিখতে লিখতেই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন।

শামসুজ্জামান খানের দাদার বাবা আলহেদাদ খান ছিলেন ফরিদপুর দর্পণ পত্রিকার সম্পাদক, উদ্ভিদবিদ্যার অগ্রপথিক জগদীশচন্দ্র বসুর বাবা ভগবানচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁরা দুজনে মিলে ফরিদপুরে একটি বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই ১৮৬১ সালে। বাবা মাহমুদুর রহমান খান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুবাদকের কাজ করতেন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তাঁর নিজের ওপরে মা শামসুন্নাহার খানমের স্নেহময় প্রভাবের কথা বলতেন। আর বলতেন তাঁর শিক্ষক ও শিক্ষক-পত্নী খলিলুর রহমান ও রোকেয়া সুলতানার কথা। রোকেয়া সুলতানাকে একাত্তরের নিঃসন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক জি সি দেব মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

শামসুজ্জামান খানের আচরণের সারল্য আর সাদাসিধা জীবন দেখে কেউ কি কখনো বুঝতে পারত, তাঁর ব্যক্তিগত আর পারিবারিক জীবনের ইতিহাসও এত বর্ণাঢ্য!