বর্ষা শেষে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলকে ভাসানচরে পাঠাতে চায় সরকার

রয়টার্স ফাইল ছবি

সরকার এবারের বর্ষা মৌসুম শেষে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে নোয়াখালীর ভাসানচরে পাঠাতে চায়। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরের ওপর চাপ কমাতেই এ উদ্যোগ।  

আজ সোমবার পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তৃতার সময় এ মন্তব্য করেন।
তবে মাসুদ বিন মোমেন বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আত্মীকরণের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা নেই।’
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) ‘রোহিঙ্গা সমস্যা: পশ্চিমা, এশীয় ও দ্বিপক্ষীয় প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা–ঢলের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে সিপিএস এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সরাতে সরকারের পরিকল্পনার বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ধার করা ৩০৬ জন রোহিঙ্গা এখন ভাসানচরে ভালোই আছেন। শিগগিরই তাঁদের স্বজন এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের একটি দলকে ভাসানচরের সরেজমিন পরিদর্শনে পাঠানো হবে। তাঁরা যদি দেখেন যে কক্সবাজারে গাদাগাদি করে থাকার চেয়ে সেখানকার পরিস্থিতি ভালো। তবে আমরা প্রাথমিক দলটিকে বর্ষা মৌসুমের শেষে পাঠানোর আশা করছি। জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলেরও সেখানে যাওয়ার কথা রয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি দেখানোর জন্য আমরা মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদেরও পাঠানোর আয়োজন করতে পারি।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় মিয়ানমারের ওপর দোষারোপ করে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরির ব্যাপারে মিয়ানমার ন্যূনতম রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বরং আমাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ব্যাপারে তাদের মধ্যে অনীহা দেখতে পেয়েছি। রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপাদানগুলোর পাশাপাশি সহায়ক পরিবেশ অবিচ্ছেদ্য অংশ।

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগে বাংলাদেশ আগ্রহী নয়। কারণ, এতে রোহিঙ্গারা দলে দলে আবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে উৎসাহিত হবে। তবে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের পর রোহিঙ্গারা যেন জীবন–জীবিকা অর্জন করতে পারে, সে জন্য ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত মিয়ানমারের কারিকুলামে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছে বাংলাদেশ।
মালয়েশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ হামিদ আলবার বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু মানবিক সমস্যা নয়, বরং এটি বৈশ্বিক ও রাজনৈতিক সমস্যা।
রোহিঙ্গা সমস্যার প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার ওপর পড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসিয়ানের কয়েকটি সদস্যদেশ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনলেও ওই সংস্থার এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো নীতি নেই। মিয়ানমার আসিয়ানের সদস্য। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আসিয়ান চরম অনীহা দেখিয়েছে। আর আসিয়ান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে মিয়ানমার যা ইচ্ছে তা–ই করে যাচ্ছে।’

হামিদ আলবার বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভূমিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তবে এই সংকটের সমাধানে ভারতও ভূমিকা রাখতে পারে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে অচলাবস্থা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের (এসআইপিজি) জ্যেষ্ঠ ফেলো মো. শহীদুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া রাখাইনে নিরাপত্তা অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পুনরায় জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো ইচ্ছা ছাড়াই শান্তি আলোচনায় মিয়ানমার অংশগ্রহণ করছে উল্লেখ করে শহীদুল হক বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে বিশ্বাস করে না এবং এই সমস্যা সমাধানের কোনো চেষ্টা মিয়ানমার কখনো করেনি।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দায়বদ্ধতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এ জন্য দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার অধীনে ‘হাইব্রিড কূটনীতি’ অব্যাহত রাখতে হবে বলে তিনি জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে, যাতে করে সেখানে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত না হয়।
কানাডার রাষ্ট্রদূত বেনোয়া প্রিফন্টেইন দায়বদ্ধতার ওপর জোর দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ বিষয়ে আরও জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আতিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা সংকট একটি জটিল সমস্যা এবং এটি সমাধানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
এসআইপিজির পরিচালক অধ্যাপক শেখ তৌফিক এম হক বলেন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় রোহিঙ্গা বিষয়ে প্রকাশনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে এবং এই অনুষ্ঠান সেটির একটি অংশ।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ইসরাত জাকিয়া সুলতানার সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সিপিএসের সমন্বয়ক এম জসিম উদ্দিন।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার মিলিটারির নির্যাতনের শিকার হয়ে ৮ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি করলেও মিয়ানমারের অনাগ্রহের কারণে এই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি।