বসনিয়ার জঙ্গলে তিন শতাধিক বাংলাদেশি

  • গত ১৯ মাসে বসনিয়ায় গেছেন ১৩০০ বাংলাদেশি

  • বলকানের চার দেশে গেছেন দেড় হাজার বাংলাদেশি

সীমান্তের দিকে অভিবাসীর দল। তাঁদের লক্ষ্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় প্রবেশ। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায়ছবি: রয়টার্স

বসনিয়া-হার্জেগোভিনার জঙ্গল ও পরিত্যক্ত ভবনে অভিবাসনপ্রত্যাশী তিন শতাধিক বাংলাদেশি আটকা পড়েছে। প্রচণ্ড শীতে পলিথিনের ছাপড়া তুলে ক্রোয়েশিয়া সীমান্তের কাছে অপেক্ষমাণ এসব অভিবাসীর শেষ গন্তব্য ছিল ইতালি।
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাগুলো গত বুধবার ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী ভেলিকা ক্লাদুসা শহরের কাছের বনে ও পরিত্যক্ত ভবনে বাংলাদেশিসহ অন্তত ৫০০ অভিবাসনপ্রত্যাশী আটকে পড়ার খবর জানিয়েছিল।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার প্রধান পিটার ভন ডার অরায়ের্ট গত শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর বলেছেন, সেখানে অপেক্ষমাণ অভিবাসীদের অধিকাংশই বাংলাদেশের নাগরিক। তিনি টুইটে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিডিও দিয়ে এ তথ্য জানান।

মুঠোফোনে ব্যস্ত এক বাংলাদেশি অভিবাসী। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বসনিয়া-হার্জেগোভিনার ভেলিকা ক্লাদুসার বনে
ছবি: রয়টার্স

পিটার ভন ডারের বক্তব্যের সমর্থনে বসনিয়া ও নেদারল্যান্ডসের কূটনৈতিক সূত্রগুলো শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে জানিয়েছে, ক্রোয়েশিয়া সীমান্তবর্তী ভেলিকা ক্লাদুসায় অবস্থানরত লোকজনের মধ্যে অন্তত ৩০০ বাংলাদেশি রয়েছে।

বসনিয়া ও অস্ট্রিয়ার কূটনৈতিক সূত্র এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও ইন্টারপোলের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বছর দু-এক ধরে বলকানের দেশ বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া আর ক্রোয়েশিয়াকে বেছে নিয়েছে মানব পাচারকারীরা। এই দেশগুলো এখন আন্তর্জাতিক মানব পাচারের প্রধান পথ হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে অন্তত দেড় হাজার বাংলাদেশি ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বলকানের ওই চার দেশে পৌঁছান। এঁদের মধ্যে অন্তত ১ হাজার ৩০০ বাংলাদেশি গেছেন বসনিয়ায়। গত বুধবার ক্রোয়েশিয়া সীমান্তবর্তী বসনিয়ার জঙ্গল আর পরিত্যক্ত ভবনে যে ৫০০ অভিবাসীর উপস্থিতির কথা বলা হচ্ছে, তাঁদের বড় অংশই বাংলাদেশের নাগরিক।

বসনিয়ার জঙ্গলে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সবশেষ অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ গতকাল শনিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী ভেলিকা ক্লাদুসার জঙ্গলে বাংলাদেশিদের বিষয়ে বসনিয়ার সরকারের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কোনো তথ্য পাইনি। তবে দেশটিতে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল হারুদিন সমুন অসমর্থিত সূত্রের উল্লেখ করে জানিয়েছেন, ভেলিকা ক্লাদুসার জঙ্গলে অবস্থানরতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিক বাংলাদেশের।’

বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সীমান্তবর্তী ভেলিকা ক্লাদুসার একটি পুরোনো পরিত্যক্ত কারখানায় বাংলাদেশি অভিবাসীরা। গত ২৯ সেপ্টেম্বরের ছবি
ছবি: রয়টার্স

মাহবুবের চতুর্থবারের চেষ্টা

শীত সামনে রেখে অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন এনেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তাই ইইউর নতুন নীতি বাস্তবায়নের আগেই ইতালিতে ঢোকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা।

বার্তা সংস্থা এএফপি গতকাল এক খবরে জানিয়েছে, বারবার চেষ্টার পরও বসনিয়া থেকে অনেকেই ক্রোয়েশিয়া প্রবেশে ব্যর্থ হচ্ছেন। তারপরও এঁদের চেষ্টা বন্ধ নেই। বাংলাদেশের ২৩ বছরের তরুণ মাহবুবুর রহমান তাঁদেরই একজন।

ভেলিকা ক্লাদুসার জঙ্গলে মাসখানেক ধরে শ তিনেক বাংলাদেশির সঙ্গে অবস্থান করছেন মাহবুব। তাঁদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। তিনি জানালেন, এর আগে তিন দফা চেষ্টা করে তিনি ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত পার হতে ব্যর্থ হয়েছেন। ক্রোয়েশিয়া পুলিশের পুশব্যাক রীতিমতো অত্যাচার। এরা টাকা, খাবার, জামা, জুতা—সবকিছু কেড়ে নিয়ে বসনিয়ায় পুশব্যাক করে দেয়। কখনো কখনো বেধড়ক পিটুনিও দেয়।

বাড়ছে মানব পাচার

বসনিয়ার একটি কূটনৈতিক সূত্র গত শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে জানান, দেশটির সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অভিবাসনপ্রত্যাশীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮ হাজার। এঁদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা ৪৮৮। ২০১৯ সালে বসনিয়ায় অন্তত সাড়ে ৮ হাজার অভিবাসীপ্রত্যাশী বসনিয়ায় পৌঁছান। এঁদের মধ্যে বাংলাদেশি ছিলেন ৭৮২ জন। তাঁদের শেষ গন্তব্য ছিল ইতালি। তবে এঁদের কতজন ইতালি যেতে পেরেছেন, সেটা স্পষ্ট নয়।

বসনিয়ায় আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) প্রধান পিটার ভন ডার অরায়ের্টকে উদ্ধৃত করে আন্তর্জাতিক এক সংস্থার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ইতালি পাড়ি দিতে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশের লোকজনের বসনিয়ায় পৌঁছানোর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

অস্ট্রিয়া ও নেদারল্যান্ডসের কূটনৈতিক সূত্রগুলো এই প্রতিবেদককে শুক্রবার জানিয়েছে, ভূমধ্যসাগর দিয়ে মানব পাচার এখন আগের চেয়ে দুরূহ হয়ে পড়ায়, পাচারকারী চক্র প্রধান পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে বলকানের ওই চার দেশকে। ফলে লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশ হয়ে মানব পাচারের সময় মুক্তিপণ, নির্যাতন, শ্রমদাসসহ যেসব অপকর্ম করা হতো, বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া আর স্লোভেনিয়ায় তা ঘটতে শুরু করেছে।

এ বছরের জানুয়ারিতে দুই বাংলাদেশি তরুণকে বসনিয়ার কোনিক শহরে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীরা বেধড়ক পেটায়। পরে পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের পর জানতে পারে ২০ ও ৩৫ বছর বয়সের ওই দুই বাংলাদেশিকে অন্যদের সঙ্গে ইতালি পাঠানোর জন্য বসনিয়ায় আনা হয়। অথচ তাঁদের ইতালি পাঠানোর আগে বাড়তি টাকা দাবি করা হয়। বাড়তি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়।

লিবিয়ায় কঠোর হওয়ার পর পাচারকারীরা এখন বলকানের দেশগুলো বেছে নিয়েছে। নতুন এই পথে মানব পাচারের সঙ্গে রিক্রুটিং এজেন্সির চেয়ে একশ্রেণির ট্রাভেল এজেন্সির দালাল চক্র জড়িত
এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী

এ বছরের জুলাইয়ে ক্রোয়েশিয়া সীমান্তবর্তী বসনিয়ার কোস্তানিকা শহরে স্থানীয় তিন মানব পাচারকারীকে পুলিশ আটক করে। বেশ কয়েকজন কিশোরসহ ১৩ বাংলাদেশিকে ইতালি পাচারের জন্য বসনিয়ায় নেওয়ার অভিযোগে তাঁদের আটক করা হয়। এ বছরের সেপ্টেম্বরে কয়েকজন বাংলাদেশিকে ইতালি পাঠানোর উদ্দেশ্যে সার্বিয়া থেকে বসনিয়ায় নেওয়া হয়েছিল। পরে বসনিয়ার কর্তৃপক্ষ সার্বিয়ায় পাঠিয়ে দেয়। গত বৃহস্পতিবার পাঁচ বাংলাদেশিকে পাচারের অভিযোগে বসনিয়ার জেনিয়া শহরে স্থানীয় এক নাগরিককে আটক করা হয়। ওই পাঁচ বাংলাদেশিকে পাঠানো হয়েছে সারায়েভোতে অভিবাসীদের অস্থায়ী শিবিরে।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, এর আগে লিবিয়ায় কঠোর হওয়ার পর পাচারকারীরা এখন বলকানের দেশগুলো বেছে নিয়েছে। নতুন এই পথে মানব পাচারের সঙ্গে রিক্রুটিং এজেন্সির চেয়ে একশ্রেণির ট্রাভেল এজেন্সির দালাল চক্র জড়িত। তাই এ সমস্যার সমাধান করতে হলে শুধু দালাল নয়, মূল হোতাদের ধরতে হবে।