বসুন্ধরা সিটিতে আগুন

রাজধানীর পান্থপথে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও রাত ১০টায় পেছনের একটি অংশে আগুন জ্বলতে দেখা যায় l ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর পান্থপথে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও রাত ১০টায় পেছনের একটি অংশে আগুন জ্বলতে দেখা যায় l ছবি: প্রথম আলো

তখনো ১১টা বাজেনি। মাত্র দোকান খুলেছেন বসুন্ধরা সিটির পঞ্চম তলার মুঠোফোন ব্যবসায়ী শাকিল মাহমুদ। এর মধ্যেই আগুনের খবর। ষষ্ঠ তলায় সি ব্লকে গিয়ে শাকিল দেখেন বন্ধ কয়েকটি জুতার দোকান থেকে গলগলিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। বিপণিবিতানটির নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা জড়ো হয়েছেন, মাঝে মাঝে অগ্নিনির্বাপণ সিলিন্ডার থেকে রাসায়নিকও ছুড়ে মারছেন। তাঁরা প্রথমে অভয় দিলেও কিছুক্ষণ পরেই ব্যবসায়ীসহ সবাইকে বাইরে যেতে বলে কর্তৃপক্ষ। এরপর সারা দিনই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেটেছে শাকিলসহ কয়েক হাজার ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীর। ধোঁয়ায় নাক-মুখ চেপে, বৃষ্টিতে ভিজে তাঁরা তাঁদের দোকানের অবস্থা জানার চেষ্টা করেছেন।
গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর অন্যতম বড় বিপণিবিতান বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগে। এতে কোনো হতাহতের খবর জানা না গেলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আগুন লাগার প্রায় ১০ ঘণ্টা পর রাত নয়টার দিকে তা নিয়ন্ত্রণে আনার ঘোষণা দেয় ফায়ার সার্ভিস। তবে এর কিছুক্ষণ পরই রাত ১০টার দিকে ভবনের সপ্তম তলায় আবারও আগুন জ্বলতে দেখা যায়। রাত পৌনে ১২টার দিকে বিপণিবিতানটির পেছনের দিকে সপ্তম তলার কাচ ভেঙে বড় মইয়ের (স্নোরকেল ল্যাডার) সাহায্যে পানি দিতে দেখা যায়। তখনো ওই তলা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, ষষ্ঠ তলার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর তাঁরা সব মালামাল নামিয়ে (ডাম্পিং ডাউন) কোথাও আগুন বা ধোঁয়া রয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখছিলেন। হঠাৎই সপ্তম তলার এ অংশে আগুন জ্বলে ওঠে।
বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, দেশের সবচেয়ে আধুনিক অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো গেছে। মাত্র সাত-আটটি দোকান পুরোপুরি পুড়ে গেছে। দুই দিনের মধ্যেই বিপণিবিতানটি পুরোপুরি চালু করা যাবে বলে জানিয়েছে তারা।
২০০৪ সালের ৬ আগস্ট রাজধানীর পান্থপথে চালু হওয়া বসুন্ধরা সিটির আটটি তলায় প্রায় পৌনে তিন হাজার দোকান রয়েছে বলে জানিয়েছেন দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এম এ হান্নান আজাদ। মূল ভবনসংলগ্ন একটি ২১ তলা ভবন বসুন্ধরা গ্রুপের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। চালু হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ বসুন্ধরার ওই ২১ তলা কার্যালয় ভবনে আগুন লেগে সাতজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছিলেন। এরপর গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর মূল বিপণিবিতান ভবনের অষ্টম তলায় (ফুডকোর্টে) একটি খাবারের দোকানে আগুন লাগে। তবে এতে খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এর মাঝে আরেকবার বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগলেও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তাতে খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের বাজারকে কেন্দ্র করে তাঁরা নতুন পণ্য তুলছিলেন। বিশেষ করে ষষ্ঠ তলায় রয়েছে জুতা, চামড়াজাত দ্রব্য, মুঠোফোন ও প্রযুক্তিপণ্যের দোকান। পুরোপুরি না পুড়লেও ধোঁয়া, তাপ ও আগুন নেভানোর জন্য ছিটানো পানিতে তাঁদের পণ্যগুলো পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। তাঁদের অভিযোগ, আগের অগ্নিকাণ্ডের পরে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ ঠিকমতো বাস্তবায়িত না হওয়ায় আবারও তাঁদের ক্ষতির মুখে পড়তে হলো। তবে বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, আগের সব সুপারিশ তারা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেছে। ‘সর্বস্বান্ত’ হওয়ার শঙ্কায় অনেক ব্যবসায়ীকে কান্নাকাটি ও বিলাপ করতেও দেখা যায়।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে জানানো হয়, বেলা ১১টা ২৩ মিনিটে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ছয়টি গাড়ি বসুন্ধরার উদ্দেশে রওনা দেয়। তার আগেই ব্যবসায়ী, ক্রেতা, অষ্টম তলার মাল্টিপ্লেক্স স্টার সিনেপ্লেক্সে আসা দর্শক ও ফুডকোর্টে অবস্থানরত লোকজনকে ভবন ছাড়তে নির্দেশ দেয় ভবনটির নিজস্ব নিরাপত্তা ও অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা। ভবনে অবস্থানরত লোকজনের বেশির ভাগই নিচে নেমে আসতে পারলেও ছাদে কয়েকজন আটকা পড়েন। নিচ থেকে ছাদে একজন নারীসহ কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছিল। বেশ কয়েক ঘণ্টা পর ছাদ থেকে ১৯ জনকে উদ্ধার করা হয়। তাঁদের মধ্যে ১০ জন বসুন্ধরার কর্মী।
বেলা দেড়টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান সাংবাদিকদের বলেন, ছাউনির ভেতর আগুন রয়েছে। ধোঁয়া বের হচ্ছে, আগুন বের করতে ছাউনি (সিলিং) কাটা হচ্ছে।
রাত নয়টার পর ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার ঘোষণা দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, রাত ৮টা ৫০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ষষ্ঠ তলার সি-ব্লকে প্রায় ১০০ দোকানের মধ্যে ৭০টি পুরোপুরি বা আংশিকভাবে পুড়ে গেছে। আগুন লাগার কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসকে বলেছে, সিলিং থেকে আগুন এসেছে। সিলিংয়ের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের তার থাকে। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক অজিৎ কুমারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তারা তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক আলফ্রেড খান বলেন, তিনি ভেতরে ঢুকেছিলেন। সি-ব্লকের প্রায় সব দোকানই পুড়ে গেছে। পুরো তলা থেকে প্রচুর তাপ বের হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসকে অনেকগুলো দোকানের শাটার কাটতে হয়েছে।
দুপুরে ঘটনাস্থলে যান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, বারবার কেন এই মার্কেটে আগুন লাগে, তিনিও সেটা জানতে চান।
বসুন্ধরা সিটির দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এম এ হান্নান আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ষষ্ঠ তলার পূর্ব দিকের খন্দকার শুরজ ও জেনিস শুরর দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত। কী কারণে আগুন লেগেছে, তা এখনো জানা যায়নি।
পঞ্চম তলার দোকান মালিক কাউসার আহমেদ বলেন, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা শুরুতে ভবনের কাচ ভাঙার পরিকল্পনা নেন। কিন্তু বসুন্ধরা সিটি কর্তৃপক্ষ ভাঙতে দেয়নি। কাচ ভাঙা গেলে ধোঁয়া বেরিয়ে পরিস্থিতির আরও দ্রুত উন্নতি হতো। তবে বসুন্ধরার কর্মকর্তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বসুন্ধরা গ্রুপের গণমাধ্যমবিষয়ক উপদেষ্টা আবু তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, বসুন্ধরা সিটিতে দেশের সবচেয়ে আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে। সেগুলো পুরোপুরি কাজ করেছে বলেই ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানো গেছে। সি-ব্লকের যে দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল, সেটিসহ ছয় থেকে সাতটি দোকান পুড়েছে। ওই তলায় থাকা অন্তত ১০০টি দোকান রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
আবু তৈয়ব বলেন, ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসও পৃথক তদন্ত কমিটি করছে। আশা করা হচ্ছে, তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে। তবে এখানে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। এর আগে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ মেনে চলা হয়েছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো পুরোপুরি মেনে চলা হয়েছিল বলেই ক্ষয়ক্ষতি কমানো গেছে।
বিকেল চারটার দিকে পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার বলেন, আগুন লাগার পর সিটির ছাদ থেকে সাতজন ও ভেতর থেকে ১১ জনকে উদ্ধার করা হয়। কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
গভীর রাতেও বসুন্ধরা সিটির আশপাশে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীরা অপেক্ষা করছিলেন।