বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা

রিকশাচিত্রে উঠে এসেছে ভাষা আন্দলোন। শিল্পী: নব কুমার ভদ্র
রিকশাচিত্রে উঠে এসেছে ভাষা আন্দলোন। শিল্পী: নব কুমার ভদ্র

‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন’। বাংলা ভাষার শক্তি ও সম্পদের প্রাচুর্য সম্পর্কে মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের এই উপলব্ধি হয়েছিল প্যারিসের অদূরে ভার্সাই নগরীতে। তারপর গঙ্গা আর বুড়িগঙ্গায় অনেক জল গড়িয়েছে। ২৮ কোটিরও বেশি মানুষের মাতৃভাষা, কমপক্ষে দুটি দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা আজ জনসংখ্যার বিচারে পৃথিবীর ভাষাগুলোর মধ্যে সপ্তম অবস্থানে।

বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, আসাম, বিহারসহ আরও কয়েকটি প্রদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম বাংলা। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়া এবং ইউরোপের প্রায় সব দেশে যে অসংখ্য বাংলাভাষী বসবাস করেন, তাঁরাও নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষার চর্চা, গবেষণা ও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও কানাডা থেকে বাংলা ভাষায় বর্তমানে একাধিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে, টেলিভিশন-বেতার চ্যানেলে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হচ্ছে বাংলা ভাষা। বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে মন্ট্রিয়ল, নিউইয়র্ক, টরোন্টো, সিডনি, মেলবোর্ন, টোকিও, ওসাকা, বেইজিং, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বহু নগরীতে।

ইউরোপ ও আফ্রিকার একাধিক দেশে মোতায়েন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। ফলে সেখানেও নানাভাবে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। আফ্রিকার একটি দেশ সিয়েরা লিওন কিছুদিন আগে বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। এভাবে বাংলা ভাষা ক্রমান্বয়ে বিশ্ব ভাষা প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ইউরোপের একাধিক দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপানে বাংলা ভাষার চর্চা ছিল। স্বাধীনতার পর থেকে গত শতকের আশির দশক পর্যন্ত বাংলাচর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়া। মস্কোর প্রগতি প্রকাশনের উদ্যোগে রুশ ভাষার ধ্রুপদি বইগুলোর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হতো এবং নামমাত্র মূল্যে সেগুলো বিক্রি হতো বাংলাদেশে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর অবশ্য এই উদ্যোগ হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়।

বাংলাদেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি বাংলাচর্চা হয় ইউরোপ ও আমেরিকায়। এ দুই মহাদেশে একাধিক নজরুল ও রবীন্দ্র সেন্টার রয়েছে। ইংল্যান্ডের ইস্ট লন্ডন, ম্যানচেস্টার ও বার্মিংহামে অসংখ্য বাংলাভাষীর বাস। সেখানকার সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে বাংলা শেখা ও চর্চার সুযোগ রয়েছে। ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় গবেষণাকর্ম পরিচালিত হয়, দেখতে পাওয়া যায় নানা ধরনের প্রকাশনা। মুক্তযুদ্ধের আগে থেকেই লন্ডনের সোয়াস নামের শিক্ষায়তনে প্রাচ্যবিদ্যা ও ভাষাচর্চা বিভাগে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে, চলছে গবেষণাও। যুক্তরাজ্যে বাংলা ভাষাকে গবেষণার বিষয় করেছেন জেডি এন্ডারসন, টি ডব্লিও ক্লার্ক (কেমব্রিজ), জন বোল্টন, উইলিয়াম রাদিচে, হানারুথ থমসন প্রমুখ। তাঁদের কারোরই মাতৃভাষা বাংলা নয়। হানারুথ থমসন সোয়াসে বাংলার শিক্ষক ছিলেন, ইংরেজিতে বাংলা ভাষার একটি ব্যাকরণও লিখেছেন তিনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অদিতি লাহিড়ি বাংলা রূপতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন কয়েক দশক ধরে। এ ছাড়া সেখানে সিলেটি নাগরি লিপি নিয়ে কাজ করছেন জেমস লয়েড দম্পতি ও রজার গোয়েন।

যুক্তরাজ্যের পরে বাংলাচর্চা ও গবেষণার অন্যতম স্থান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণাকেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে, যার মধ্যে নিউইর্য়ক, ইথাকা, শিকাগো, মিনেসোটা, ফ্লোরিডা, মেরিল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া, উইলকিনসন, হার্ভার্ড উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার অর্থ প্রকাশে মনস্তত্ত্বের ভূমিকা নিয়ে কাজ করছেন জাস্টিন আলফানসো চাকোন। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশি বংশদ্ভূত রাশাদ আহমেদ গবেষণা করছেন বাংলা অপশব্দ বা ‘স্ল্যাং’ নিয়ে। নিউইয়র্কে মারিয়া হেলেন বেরো কাজ করেন নজরুল সাহিত্য নিয়ে। এ বিষয়ে তাঁর একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলা ভাষা শিক্ষাদান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, লালন, চর্যাপদ ও মধ্যযুগের সাহিত্য নিয়ে। যেসব গবেষক এ কাজে জড়িত ছিলেন এবং আছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন ক্লিন্টন বুথ সিলি, র‍্যাচেনল ভন বমার, রালফ নিকোলাস, ডেভিড কফ ব্যাচেলবাওয়া, ক্যারল সলোমন, রিকি সলোমন, উইন্সটন ল্যানলি, ক্যারোলিন রাইট, হেনরিগ্রাসি, কেলম্যান, এন্ড্রু সিম্পসন, আন ডেভিড প্রমুখ। তঁদের মধ্যে ক্লিন্টন বুথ সিলি কবি জীবনানন্দ দাশের সাহিত্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। এন্ড্রু সিম্পসন দক্ষিণ কালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি বংশদ্ভূত দুই বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক সলিম-উদ-দৌলা খান ও ভারতের ইন্দ্রনীল দত্ত উচ্চতর গবেষণা করেছেন বাংলা ধ্বনিবিজ্ঞান নিয়ে।

আমেরিকার নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস কিংবা লস অ্যাঞ্জেলেসে গড়ে উঠেছে বাঙালি পাড়া, যেখানে বাংলা ভাষার এক নতুন প্রবাসী-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডায় বাংলা ভাষার চর্চা ও গবেষণা হচ্ছে। সেমিনারও হয় নিয়মিত। বর্তমানে উত্তর আমেরিকায় দুই বছর পর পর নজরুল সম্মেলন হচ্ছে। ফ্লোরিডায়ও বাঙালিদের মিলন উৎসবে বাংলা ভাষার চর্চা ও আলোচনা চলছে নিয়মিত।

কানাডায় প্রয়াত অধ্যাপক জোসেফ ওকনেল, ভ্যাংকুভারে ব্যারি মরিসন বাংলা ভাষার অধ্যাপনা ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজেন্দ্র সিংহের তত্ত্বাবধানে বাংলা শব্দ গঠন বিষয়ে গবেষণা হয়েছে সেই ২০০৭ সালে। রাজেন্দ্র সিংহ সম্পাদিত সাউথ এশিয়ান জার্নাল অব ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিঙ্গুইস্টিকস শিরোনামের গবেষণামূলক পত্রিকায় বাংলা ভাষা নিয়ে নিয়মিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সাল পর্যন্ত। কানাডার টরোন্টো ও মন্ট্রিয়ল থেকে বেশ কয়েকটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে বাংলা কাগজ। টরোন্টোর ভিক্টোরিয়া পার্ক-ড্যানফোর্থ এলাকায় গড়ে উঠেছে বাঙালি পাড়া। টরোন্টোতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় বাংলা। টরোন্টো থেকে ইকবাল হাসান প্রকাশ করেন বাংলা জার্নাল নামে একটি সাময়িকী।

অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাঙালিরা নিয়মিত বাংলাচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। কয়েক দশক আগে বাংলা ভাষা বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে মারিয়ম মাডার্ন, শিবনারায়ণ রায় ও আবু সয়ীদ আইয়ুবের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয় সে দেশের বিদ্যালয়ে যেসব এশীয় ভাষা শেখার অনুমতি দিয়েছে এবং যেসব ভাষা শেখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলার অবস্থান তৃতীয়।

জাপান, চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে অগ্রণী নিঃসন্দেহে জাপান আর চীন। জাপানে প্রায় ৭০ বছর আগে কাজুয়ো আজুমা রবীন্দ্রপ্রেম থেকে বাংলা ভাষার চর্চা শুরু করেছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা করে তাঁর সারা জীবন কেটে গেছে। কেই শিরাই, অধ্যাপক নারা (সম্প্রতি প্রয়াত), কাজুহিরো ওয়াতানাবে, কিউকা নিওয়া, তোগাওয়া মাসিকোসহ বেশ কয়েকজন গবেষক জাপান ফাউন্ডেশন ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষকতা করেছেন, করছেন। টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে বাংলা ভাষা শেখানো শুরু হয়েছে পাঁচ বছর আগে। বর্তমানে এই বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩০ জন। সেখানে পাঠদান করছেন কিউকা নিওয়া, কাজুহিরো ওয়াতানাবে, মনজুরুল হক প্রমুখ। আর কিয়োতো ও ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে বাংলা ভাষা শিক্ষা দিচ্ছেন বাংলা ভাষার তরুণ গবেষক হুজিয়ারা। বাংলাদেশের চাক ভাষাও তাঁর গবেষণার বিষয় এবং এই ভাষায় তিনি একটি অভিধান রচনা করছেন। এ ছাড়া গিফু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিদিকি মাকি বাংলা ও জাপানি ভাষার বাক্য গঠন নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা করছেন। রেডিও এনএইচকেতেও কাজুহিরো ওয়াতানাবের নেতৃতে বাংলা ভাষা শিক্ষাসহ নিয়মিত বাংলা অনুষ্ঠান হচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরে চীনের রেডিও বেইজিং থেকে বাংলায় সম্প্রচার চলে আসছে। চীন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু বাংলা অনুবাদকর্ম। কয়েক বছর ধরে সেখানে ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ চলছে। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বাংলা থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদের কাজ করছেন সিআরআইয়ের (চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনাল) প্রায় ৩০ জন সাবেক কর্মী। তা ছাড়া চায়না ব্রডকাস্টিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান চাংসিং বেশ কিছু চীনা ভাষাবিদ-গবেষককে বাংলা-চীনা-বাংলা অনুবাদ এবং বাংলা ভাষাবিষয়ক গবেষণা প্রকল্পে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সস্পর্ক বৃদ্ধির কারণে চীনে বাংলা শেখার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। সে দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে বাংলা ভাষার ওপর গবেষণা। বাংলা ভাষার কোর্স চালু হয়েছে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ চালু করেছে বাংলা ভাষার কোর্স। সেখানে তারা বাংলা বিষয়ে স্নাতক সম্মানও চালু করবে। অধ্যাপক জিং কুইং বাংলা নিয়ে কাজ করছেন সেখানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের বাংলা ভাষার প্রাক্তন চীনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে বর্তমানে চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শিক্ষাদানে নিয়োজিত রয়েছেন। এই শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের মধ্যে কয়েকজন এত ভালো বাংলা বলেন যে ফোনে তাঁদের বাংলা শুনে বোঝাই যায় না তাঁরা বাঙালি নন।

ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রে বাংলা ভাষার চর্চা ও গবেষণা চলছে। ফ্রান্সে বাংলা থেকে ফরাসি অনুবাদকদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রান্স ভট্টাচার্য্য, পৃথ্বীন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও প্রবাল দত্তগুপ্ত। বিপ্লবী বাঘা যতীনের নাতি পৃথ্বীন্দ্র মুখোপাধ্যায় অনুবাদ করেছেন বাউল গান ও কথাসাহিত্যিক শংকরের উপন্যাস। ফ্রান্স ভট্টাচার্য্য অনুবাদ করেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালি, জীবনানন্দ দাশের কবিতা এবং সম্প্রতি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত প্রাচ্যভাষা ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটে ফ্রান্স ভট্টাচার্য্য প্রায় তিন দশক ধরে বাংলা ভাষায় শিক্ষা দিচ্ছেন। এই ইনস্টিটিউটে পড়িয়েছেন মাহমুদ শাহ কোরেশী, শিশির ভট্টাচার্য্যসহ আরও অনেকে। বর্তমানে এই ইনস্টিটিউটের বাংলা বিভাগের দায়িত্বে আছেন ফিলিপ বনোয়া। উল্লেখ্য, বনোয়ার পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল কৃত্তিবাসী রামায়ণ

হাইডেলর্বাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবাসী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, মার্টিন কেম্পসন প্রমুখের হাতে বাংলাচর্চার সূচনা হয়েছে। জোসেফ বায়ার কাজ করছেন জার্মানির কনস্ট্যাঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবার হ্যান্স হার্ডার বাংলা চর্যাপদ নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন। ইটালিতে অধ্যাপক মারামারা কাজ করছেন বাংলা নিয়ে। পোল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এলভিয়েতা ওয়োল্টার বাংলা থেকে পোলিশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও বিভূতিভূষণের রচনা। কিছুদিন আগে প্রয়াত বেলজিয়ামে ফাদার দাতিয়েন বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন ধরে। বাংলা ভাষার পুরোনো বই বা পাণ্ডুলিপি থেকে শুরু করে অনেক বিষয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন তিনি। বাংলা পত্রিকায় লিখেছেনও নিয়মিত। বাংলাদেশেও এসেছিলেন তিনি। নরওয়ের থ্রমসো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিলিয়ান রামচান্দ, নেদারল্যান্ডসের গবেষক ভিক্টর ভ্যান বিজার্ট, অধ্যাপক উইলিয়াম ভ্যানদার উফ বেঙ্গল স্টাডিজ ও বাংলা ভাষাতত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন। অতি সম্প্রতি জানা গেছে, ডেনমার্কের অলবো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বিষয়ে গবেষণার জন্য একটি বেঙ্গল স্টাডি সেন্টার খোলার প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

চেক রিপাবলিকে প্রথম মহাযুদ্ধ-পরর্বতীকালে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলাচর্চা শুরু হয় মূলত রবীন্দ্রনাথের নোবেল বিজয়ের পরপর। ভি লেসলি, দুশন জভাভিতলে ও হান্না পেইনরো হেলতেমেভা এ ক্ষেত্রে রেখেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। কয়েক বছর থেকে প্রাহা (প্রাগ) বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা শেখানো হচ্ছে। সেখানে বাংলা বিভাগে পড়ান মার্টিন রিভেক। তাঁর গবেষণার বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হলো বাংলা কবিতা।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্যান্য প্রদেশেও চলছে বাংলা গবেষণা। এর মধ্যে দিল্লি, আসাম, ওডিসা, মাদ্রাজ, ত্রিপুরা উল্লেখযোগ্য। ভারতে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং বর্তমানে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের গবেষক অধ্যাপক প্রবাল দাশগুপ্তের কথা। পদাশ্রিত নির্দেশক, যৌগিক ক্রিয়া, বাংলা নামবর্গসহ বাংলা ব্যাকরণের বহু ক্ষেত্রে তিনি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন পাঁচ দশক ধরে।

বাংলাদেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত প্রায় ১ কোটি বাঙালি তাঁদের মাতৃভাষার দীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন। সেখানে অবশ্য বাংলা ভাষার চর্চা বা গবেষণা হয় না। তবে প্রকাশিত হয় বাংলা সংবাদপত্র। মরক্কোতে আরবি ভাষায় নজরুল সাহিত্য অনুবাদ হচ্ছে বলে জানা গেছে।

বর্তমান রচনায় বহির্বিশ্বে বাংলাচর্চার সব উদ্যোগকে ধারণ করা অবশ্যই সম্ভব হয়নি। সব গবেষক-অধ্যাপকের নামও হয়তো বলা গেল না। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে বহির্বিশ্বে বাংলাচর্চা ক্রমবর্ধমান। উপরন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে পৃথিবীতে বাংলা ভাষার পরিচিতি তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। বলা বাহুল্য, প্রবাসী বাঙালিরাই বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারের প্রধান উদ্যোক্তা। তবে বাংলাচর্চায় উৎসাহী অবাঙালিদের অবদানের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। শেষে প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা বলতে চাই, বাংলা শিখতে আগ্রহী অবাঙালিদের শিক্ষার্থী ভিসা পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করা উচিত, যাতে করে তাঁরা বাংলাদেশে এসে বাংলা শিখতে পারেন। এরপর নিজের দেশে ফিরে গিয়ে অন্যদের ভেতরেও ছড়িয়ে দিতে পারেন বাংলা ভাষার চর্চা।