বাংলাদেশের খাবার অনেক ভালো

চলতি বছরই অস্ট্রেলিয়ার মাস্টারশেফ প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন সে দেশে প্রবাসী বাংলাদেশি কিশোয়ার চৌধুরী। এর থেকেও বড় ব্যাপার হলো কিশোয়ারের এই জয় এসেছে বাঙালি রান্না দিয়েই। দেশি রান্না দিয়েই মাত করেছেন বিদেশের প্রতিযোগিতা। কিশোয়ারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সনদপ্রাপ্ত মাস্টারশেফ এবং নেব্রাস্কার ব্রায়ান মেডিকেল সেন্টারের এক্সিকিউটিভ শেফ নাজিম খান

কিশোয়ার চৌধুরীর আশা, দেশ দেশান্তরে ছড়িয়ে যাবে বাংলাদেশি রান্না
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

নাজিম খান: মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় তো আপনি অংশ নিলেন। সেখানে যাওয়ার জন্য অপনার অনুপ্রেরণা কী ছিল?

কিশোয়ার চৌধুরী: আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। আমার জন্মের আগেই বাবা কামরুল হোসাইন চৌধুরী ও মা লায়লা চৌধুরী অস্ট্রেলিয়া চলে আসেন। জন্ম থেকে এখানে বসবাস করলেও দেশীয় ভাবধারায় আমরা গড়ে উঠেছি। আদতে আমাদের পরিবারে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা ছিল। মনে পড়ে, এই মেলবোর্ন শহরেও আমি দেশের মতো প্রতিদিন অন্তত এক বেলা ভাত বা দেশি খাবার খেতাম। যেমন লাল চিংড়ি, আলুভর্তা, সবজি ইত্যাদি। ঈদ বা অন্যান্য উৎসবেও আমরা দেশি খাবার খেতাম এবং এখনো খাই।

বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে আমরা সব সময় জড়িত থাকতাম। বাংলাদেশের সব বিশেষ দিন যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি বা স্বাধীনতা দিবসে পুরোপুরি বাঙালি সংস্কৃতি অনুসরণ করে গান করি আমরা, পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন করি। এসব আমার বাবা-মা করতেন। তাঁদের কাছ থেকে আমরা শিখেছি। বাবা-মায়ের কাছেই আমার বাংলা সংস্কৃতি বুঝতে শেখা। এখানকার বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁদের অবদান আছে। আমার দুই ছেলেমেয়ে—মিকাইল ও সেরাফিনা। ওদের এই ব্যাপারগুলো আমি সব সময়ই বলি। আমার ছেলেমেয়েরা বাঙালি খাবার খেতে খুবই পছন্দ করে। মূলত নিজেদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি এবং বাঙালি ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যই আমি বাঙালি খাবার রান্না করি। এটা আমি আমার বাবা-মায়ের সূত্রে পেয়েছি। তাই নিজে যখন মা হয়েছি, তখন আমিও চেয়েছি যে আমার সন্তানেরা যেন এই দেশে কারও সঙ্গে মিশতে লজ্জা না পায়, তারা যেন হীনম্মন্যতায় না ভোগে। কারণ, আমাদের ঐতিহ্য অনেক গৌরবের। বাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ঐশ্বর্য অনেক।

প্রশ্ন :

নাজিম খান: বাংলা সংস্কৃতির পাঠ নিতে নিতেই কি আপনার বাঙালি রান্না শেখা?

কিশোয়ার চৌধুরী: বাংলা সংস্কৃতির মতো বাঙালি রান্নাও আমি পরিবার থেকে শিখেছি। আমার বাবা-মা দুজনেই খুব ভালো রান্না করেন। আর ছোটবেলা থেকেই আমরা খুব স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে অভ্যস্ত। যেমন ধরেন, বাগানের সবজি, বাগানের ফল কিংবা ধনেপাতা, পেঁয়াজপাতা—এগুলো দিয়ে আমার বাবা-মা চমৎকার সব বাঙালি পদ রাঁধেন। ওই সব রান্না দেখে এবং খেয়েই রান্নায় আমার হাতেখড়ি।

প্রশ্ন :

নাজিম খান: আমি পড়েছি আপনি বিখ্যাত জাপানি শেফ মাসাহিকা ইয়োমোদোর কাছে শিক্ষানবিশি করছেন। তিনি তো ফরাসি রান্নায় পারদর্শী...

কিশোয়ার চৌধুরী: মাসাহিকা ইয়োমোদো আদতে ফরাসি ও জাপানি রান্নায় বিশেষজ্ঞ। তিনি তাঁর ফরাসি রান্নার জ্ঞানটাকে জাপানি কেইসিকি ধারার রান্নার সঙ্গে যোগ করে মিশেলিন স্টার পেয়েছেন। তাই তিনি একজন মিশেলিন স্টার শেফ। তাঁর দুটি মিশেলিন স্টার আছে। খুব বড় মাপের শেফ তিনি। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি গর্বিত ও সম্মানিত বোধ করি। আমি তাঁর কাছ হাত ধরে গড়ে উঠছি।

প্রশ্ন :

নাজিম খান: আমারও দুজন মাস্টারশেফের কাছে হাতেখড়ি। একজন শেফ জর্জ ম্যানিল। আরেকজন জ্যাকুইস সরসি। জর্জ ম্যানিরের কাছে আমি ছয় বছর রান্না শিখেছি এবং তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। আমার গড়ে ওঠা তাঁর কাছেই। গত বছরের নভেম্বরে আমি মাস্টারশেফ সনদ পেয়েছি। আমি আদতে পুরান ঢাকার ছেলে। যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি পড়াশোনার জন্য। তারপর থেকে এখানে থিতু হই।

কিশোয়ার চৌধুরী: আমার বাবাও পুরান ঢাকার। পুরান ঢাকায় দাদার বাড়িতে অনেক মজার মজার রান্না খেয়েছি—এই স্মৃতি আমার মনে এখনো উজ্জ্বল। আমার বাবা-মা এখনো এখানে অমন রান্না করেন। বাংলাদেশে নারীরা রান্না করে, সেই তুলনায় ছেলেরা খুব কমই রান্না করে। আপনার কি বাংলাদেশে রান্নার অভিজ্ঞতা আছে?

প্রশ্ন :

নাজিম খান: না, দেশে থাকতে রান্নার অভিজ্ঞতা একেবারেই ছিল না। আমার বাবা চাইতেন না আমি রান্নাঘরে যাই। তিনি আমাকে পড়াশোনা করতে দেখলে খুশি হতেন। আমার বাড়ির পাশে আমার খুব পছন্দের হাজীর বিরিয়ানি ছিল। আলাউদ্দিনের মিষ্টির দোকান, নান্নার বিরিয়ানি। পুরান ঢাকার ইফতারি খুব বিখ্যাত, এসবের পাশেই আমরা বসবাস করতাম।

কিশোয়ার চৌধুরী: হুম, পুরান ঢাকার নাশতা আসলেই খুব ভালো। আমার দাদা পুরান ঢাকা থেকে যখন মোহাম্মদপুরের চলে যান, তখন প্রতিবছর আমরা ঢাকায় বেড়াতে যেতাম। আমি বুঝতে পারতাম এসব ইফতারি ও নাশতার জন্য ঢাকা কত ভালো একটা জায়গা!

প্রশ্ন :

নাজিম খান: কেউ পুরান ঢাকার এই সব খাবারকে টেক্কা দিতে পারবে না। আমার মনে হয়, পুরান ঢাকায় বড় হয়েছি বলেই আমার শেফ হওয়া। মাস্টারশেফ হওয়ার আগে কি আপনার কোনো পেশাদারি অভিজ্ঞতা ছিল?

কিশোয়ার চৌধুরী: মাস্টারশেফ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পূর্বশর্ত ছিল কোনো পেশাদারি প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে পারবে না। মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ায় অংশ নেওয়ার আগে প্রতিযোগীরা কোনো ধরনের কালিনারি স্কুল বা কোর্সে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এ জন্য অধিকাংশ প্রতিযোগীই বিভিন্ন পেশা থেকে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে থাকে। রান্নার প্রতি ভালোবাসা থেকেই এখানে সবাই অংশগ্রহণ করে।

কিশোয়ার চৌধুরী

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান মাস্টারশেফ

জন্ম

১৯৮৩, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

পড়াশোনা

মেলবোর্নের মোনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে

বাণিজ্যে স্নাতক, লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব দ্য আর্টস থেকে গ্রাফিক ডিজাইনে স্নাতকোত্তর

প্রিয় বাংলাদেশি খাবার

ইলিশ মাছের পাতুরি

ঢাকায় প্রিয় খাবার

ফুচকা ও চটপটি

অর্জন

মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া প্রতিযোগিতার

দ্বিতীয় রানারআপ

প্রশ্ন :

নাজিম খান: মাস্টারশেফে অংশ নিতে আপনাকে কেউ বলেছে, নাকি নিজে নিজেই অংশ নিলেন?

কিশোয়ার চৌধুরী: আমার ছেলের উৎসাহেই আমি এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। আগেই বলেছি, পারিবারিকভাবেই আমরা প্রাকৃতিক বা অর্গানিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন যাকে বলে আরকি। তো আমার ছেলেই আমাকে বারবার বলেছে, মা, এই প্রতিযোগিতায় অংশ নাও। সে নিজেও প্রতিযোগিতাটিতে আবেদন করেছিল, যা ছিল আমার জন্য বড় অনুপ্রেরণা। সত্যি বলতে, এই প্রতিযোগিতার পর্বে পর্বে আমার ছেলে আমাকে গাইড করেছে। যেমন—মা, তোমার এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। এগুলো আমাকে মা হিসেবে গর্বিত করে।

প্রশ্ন :

নাজিম খান: মাস্টারশেফ প্রতিযোগিতায় আপনি বাংলাদেশি খাবার বেশি পরিবেশন করেছেন। অনেক দেশের অনেক খাবারের মধ্যে আপনি কেন বাংলাদেশি খাবার পরিবেশন করলেন?

কিশোয়ার চৌধুরী: আমি মনে করি, বাংলাদেশের খাবার শুধু ভালো নয়, অনেক ভালো। পৃথিবীর যেকোনো বিখ্যাত ডিশের মতোই এই খাবারগুলো অনন্য।

প্রশ্ন :

নাজিম খান: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনাকে তরুণেরা খুব অনুসরণ করে। অনেকেই এখন এই রন্ধনশিল্পে আসতে চায়। তাদের জন্য কী উপদেশ দেবেন?

কিশোয়ার চৌধুরী: এই পেশায় আসার প্রথম শর্তই হলো আপনাকে কর্মঠ হতে হবে। অলসদের জন্য এই পেশা নয়। রান্নার প্রতি ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে হবে। একজন যখন শেফ জ্যাকেট পরবে—সে ছেলে কিংবা মেয়ে যা–ই হোক—তাকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। আর থাকতে হবে উদ্ভাবনী ক্ষমতা।

প্রশ্ন :

নাজিম খান: মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া প্রতিযোগিতার সময়ই আপনি বলেছিলেন, রান্না নিয়ে আপনার স্বপ্ন হলো বাংলাদেশি একটি রান্নার বই লিখে যাওয়া; সেই বইটা কি শুধু বাংলাদেশিদের জন্য লিখছেন, নাকি সবার জন্য?

কিশোয়ার চৌধুরী: আমি আসলে চাই এটা থেকে পৃথিবীর সবাই উপকৃত হোক। পাশাপাশি দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে যাক বাংলাদেশি রান্না। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমি বইটা লিখছি।

প্রশ্ন :

নাজিম খান: আপনার জন্য অনেক শুভকামনা রইল। শেষে আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন।

কিশোয়ার চৌধুরী: আমি এমন একজন মানুষ, যে তার পরিবারকে খুব ভালোবাসে। মানসিকভাবে আমি খুবই দৃঢ়চিত্ত, এমন এক নারী, যে তাঁর জন্মভূমি, তাঁর দেশকেও খুব ভালোবাসে।