বাংলাদেশের তরুণেরা চমকে দেবেন বিশ্বকে!

আট দেশের সহস্রাব্দের প্রজন্ম (মিলেনিয়াল জেনারেশন) চমকে দেবে বিশ্ব অর্থনীতিকে। এই আট দেশের মধ্যে সবার ওপরেই আছে বাংলাদেশ। কাজের সুযোগ দিলে এরাই হবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এ টি কার্নি সম্প্রতি এই সহস্রাব্দের প্রজন্ম নিয়ে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। ‘হোয়ার আর দ্য গ্লোবাল মিলেনিয়ালস’ নামের এই নিবন্ধেই বাংলাদেশসহ আটটি দেশের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। সেখানে সহস্রাব্দের প্রজন্মের চমকে দেওয়ার এই কথা বলা হয়েছে। এ টি কার্নির পার্টনার এরিখ আর পিটারসন, পরামর্শক কোর্টনি ম্যাক কাফরি ও অরি সিলম্যান এই গবেষণা নিবন্ধ লিখেছেন।

১৯৮২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারীদেরই বলা হয় মিলেনিয়াল বা সহস্রাব্দের প্রজন্ম। বর্তমানে যাঁদের বয়স ১৯ থেকে ৩৫-এর মধ্যে, ভোগব্যয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে তাঁদেরই অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করা হয়। বিশ্বে মোট জনসংখ্যা এখন প্রায় ৭৪০ কোটি। এর মধ্যে সহস্রাব্দের প্রজন্মের সংখ্যা ২০০ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ।

গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে, প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক হলে এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করে দিতে পারলে তা একটি দেশে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। এতে বাজার বড় হয় এবং ব্যবসায়ীরা বড় একটি বাজারে পণ্য বিক্রি করার সুযোগ পায়। বিশ্বের আটটি দেশে বর্তমানে এ ধরনের সুযোগ সবচেয়ে বেশি। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, মিসর, ভারত, ইরান, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভিয়েতনাম। এই আটটি দেশে মিলেনিয়াল প্রজন্মকে সম্পদ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। আর তাদের ওপরেই নির্ভর করছে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ। এই আট দেশের তালিকায় সবার ওপরে আছে বাংলাদেশ।

সামগ্রিকভাবে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রাজিলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মিলেনিয়াল প্রজন্মের বসবাস। আবার এই পাঁচটি দেশ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল। তবে গবেষকেরা বলছেন, কেবল বেশিসংখ্যক মিলেনিয়াল প্রজন্ম থাকাটাই যথেষ্ট নয়, বরং দেশটির মোট জনসংখ্যার তুলনায় এই প্রজন্ম বেশি না কম, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এদিক থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশসহ আটটি দেশ। এই আটটি দেশকে গবেষকেরা নাম দিয়েছেন ‘মিলেনিয়াল মেজরস’। দেশ আটটিকে এখন ‘এমারজিং মার্কেট’ বা উঠতি বাজারের দেশও বলা হয়।

গবেষণা অনুযায়ী, আট দেশের মধ্যে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। এই তিন দেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব তুলনামূলকভাবে কম। আর এই তিন দেশেরই প্রাক্কলন হচ্ছে, আগামী পাঁচ বছরে প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যায় মিলেনিয়াল প্রজন্মের সংখ্যা ৪ কোটি ৯৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ।

তবে বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার কম হলেও এ নিয়ে সমস্যা আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ দেশের শিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত যুবক-যুবতীরা নিজেদের পছন্দমতো কাজ পাচ্ছেন না। এটা বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যা। একজন এইচএসসি পাস তরুণ পছন্দ অনুযায়ী কাজ না পেয়ে হয়তো বাধ্য হয়ে মুদি দোকান করছেন, এতে ওই যুবক সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, বাংলাদেশে শ্রমবাজারে আছে ৬ কোটি ১৪ লাখ জন। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী আছেন ২ কোটি ৩ লাখ ৮৬ হাজার। তাঁদের মধ্যে চাকরি বা কাজ করছেন ১ কোটি ৮৪ লাখ ৪৭ হাজার। বাংলাদেশে মোট বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ। তাঁদের মধ্যে ১৯ লাখই তরুণ-তরুণী, যা দেশের মোট বেকারের ৭৩ শতাংশ। তাঁরা সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজের সুযোগও পান না।

আবার ১৯ লাখ তরুণ বেকারের মধ্যে মাধ্যমিক পাস করে বেকার বসে আছেন প্রায় পৌনে ৮ লাখ। আর সাড়ে ৬ লাখ উচ্চমাধ্যমিক পাস করেও কোনো কাজ পাচ্ছেন না। স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বসে আছেন ৭৮ হাজার তরুণ-তরুণী।

ফলে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টির উপযোগী কি না, প্রশ্ন তোলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি মনে করেন, চাকরি নিয়ে উচ্চশিক্ষিতদের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে। এটা তাঁদের দোষ নয়; শিক্ষাব্যবস্থার দোষ। আবার কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। শিল্প খাতে কী ধরনের মানবসম্পদের দরকার, এটা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বুঝতে পারছে না। এটা একটি কাঠামোগত সমস্যা।

এই অবস্থায় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে তরুণ প্রজন্মকে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে বলে মনে করেন শামসুল আলম। তাঁর মতে, কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

গবেষণা অনুযায়ী, আগের প্রজন্ম কর্মক্ষেত্র থেকে অবসরে যাওয়া শুরু করার কারণে এই মিলেনিয়াল প্রজন্ম সারা বিশ্বেই অর্থনীতির জন্য এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আগের প্রজন্ম ধীরে ধীরে স্বল্প ভোগের জীবনে চলে যাচ্ছে। তাদের চাহিদাও কমছে। আর যাঁরা তরুণ, চাকরির বাজারে ঢুকেছেন, তাঁদের চাহিদা বাড়ছে, ভোগও বাড়ছে। এ কারণেই উদ্যোক্তাদের কাছে এই মিলেনিয়াল প্রজন্ম পণ্য বিক্রি ও ব্যবসা বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশের অগ্রগতি নির্ভর করছে সহস্রাব্দের প্রজন্মের ওপর। আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এই প্রজন্মের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। তাহলেই ‘পপুলেশন ডিভিডেন্ড’ বা জনসংখ্যার বোনাস পাবে এসব দেশ।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলম সবশেষে প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১২ সালে আমরা জনসংখ্যা বোনাসের যুগে প্রবেশ করেছি। এ সুবিধা থাকবে ২০৩৬-৩৭ সাল পর্যন্ত। একটি জাতির জীবনে এ সুযোগ একবারই আসে। এ সময়ে যুবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগগুলো নিতে হবে।

অন্যান্য দেশের পরিস্থিতি: গবেষণা নিবন্ধ অনুযায়ী, আটটি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানে তরুণ বেকারের সংখ্যা বেশি হলেও আগামী পাঁচ বছরে প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে তা নির্ভর করছে অর্থনৈতিক সংস্কার কতটা এগিয়ে নিতে পারবে তার ওপর। অন্য দেশগুলোর মধ্যে নিরাপত্তার সমস্যায় মিসরে পর্যটক কমে গেছে, বিদেশি বিনিয়োগও কমেছে। বিশ্বব্যাপী ভোগ্যপণ্যের দাম কমে যাওয়ার প্রভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। আর দুর্নীতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় সমস্যায় আছে ইরান।

আবার যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মতো ধনী দেশগুলোতে সহস্রাব্দের প্রজন্মের সংখ্যা বেশি থাকলেও এখানে সমস্যা একটু অন্য রকম। কেননা, সম্পদশালী হলে জন্মহার কমে এবং গড় আয়ু বৃদ্ধি পায়। ফলে এসব দেশে তরুণদের তুলনায় বয়স্কদের সংখ্যা বেশি হয়ে যায়। চীন এক সন্তান নীতি নিয়েও একই ধরনের সমসার মধ্যে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণেরা বড় ভোক্তা হলেও শিক্ষাঋণের দায় তাঁদের ওপর অনেক বেশি। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে গ্রিসের মিলেনিয়ালরা। তাদের বরং বলা হচ্ছে ‘লস্ট জেনারেশন’। এরা মনে করে, বড়রা তাদের ভবিষ্যৎকে নষ্ট করে দিচ্ছেন।

১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ টি কার্নি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। ‘ফরচুন গ্লোবাল ৫০০’ নামে পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ৫০০ কোম্পানির দুই-তৃতীয়াংশ তাদের সেবা নিয়ে থাকে। বিশ্বের ৪০টি দেশে ৬২টি কার্যালয় রয়েছে এ টি কার্নির।