বাংলাদেশের প্রথম অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি ভুটানের সঙ্গে

ভুটানের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে  ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ রোববার গণভবনে
ছবি: ফোকাস বাংলা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ-ভুটান অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) পারস্পরিক স্বার্থের দিক দিয়ে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও সুসংহত করবে। আজ রোববার গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়াল প্লাটফর্মে ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম পিটিএ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন সময় এসেছে আমরা পারস্পরিক সুবিধার জন্য এবং উভয় দেশের নাগরিকদের সামগ্রিক উন্নতি ও কল্যাণের জন্য আমাদের অসাধারণ সম্পর্ককে আরও বেশি অর্থবহ করে তুলি। এ চেতনায় আমরা আজ ভুটানের সঙ্গে পিটিএতে স্বাক্ষর করেছি। এ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ এবং ভুটান থেকে বিস্তৃত পণ্য একে অপরের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে। চুক্তিতে পারস্পরিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে অতিরিক্ত তালিকা অন্তর্ভুক্ত করারও বিধান রয়েছে।’

শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কেননা আমরা বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের প্রথম পিটিএ স্বাক্ষর করছি। আর ভুটানই প্রথম দেশ, একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং সে দেশের রাজধানী থিম্পু থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। রাজধানীর বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে মূল অনুষ্ঠানের অন্য প্রান্তে ভুটানও সংযুক্ত ছিল।

বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এবং ভুটানের অর্থমন্ত্রী লিয়নপো লোকনাথ শর্মা নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ভুটানের স্বীকৃতি দেওয়া এই দিনটিকে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে দুই দেশ অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের দিন হিসেবে বেছে নেয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টান্ডি দরজি এবং অর্থমন্ত্রী লিয়নপো লোকনাথ শর্মা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশের বাণিজ্যসচিব জাফর উদ্দিন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।

চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশ প্রান্তে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প এবং বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন, এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, বাংলাদেশে ভুটানের রাষ্ট্রদূত কুসাব রিনচেন কিউয়েনটিল এবং ভুটানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ কে এম শহিদুল করিম থিম্পু প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ-ভুটান সম্পর্কের ঐতিহাসিক দিনটি উপলক্ষে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী একযোগে একটি লোগো উন্মোচন করেন এবং পৃথক কেক কাটেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ চুক্তির ফলে ভুটান তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্য এবং ইলেকট্রনিকসসহ ১০০টি বিভিন্ন বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক সুবিধা প্রদান করতে সম্মত হয়েছে। অন্যদিকে ফলমূলসহ ৩৪টি ভুটানের পণ্য বাংলাদেশে একই সুবিধা পাবে। পরে আলোচনার মাধ্যমে আরও পণ্য দুই দেশের তালিকায় সংযুক্ত করা হবে। এ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় পিটিএ এবং এফটিএ স্বাক্ষরের যাত্রা শুরু হবে।

প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভুটানের তৃতীয় রাজা এবং জনগণের অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের হৃদয়ে ভুটানের একটি বিশেষ অবস্থান এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্থায়ী জায়গা রয়েছে।

১৯৭১ সালের এই দিনে ভুটানের স্বীকৃতি প্রদানের ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁরা তখন রাজধানীর একটি একতলা বাড়িতে তিন মাসের শিশু সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শিশু রাসেলসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী, বাবা বন্দী পাকিস্তানে। শেখ কামাল এবং শেখ জামাল পালিয়ে তখন মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছেন। এমন অবস্থায় সেদিন মেঝেতে বসে ছিলেন তখনই এই সংবাদ তাঁরা পান।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুহূর্তেই আমাদের সব দুঃখ, কষ্ট ভুলে গেলাম, আমরা চিৎকার-চেচাঁমেচি, হুল্লোড় এবং কান্না জুড়ে দিলাম, যা আমি কখনো ভুলতে পারব না। দীর্ঘ সময় বন্দী অবস্থায় কাটানোর পর এটি এমনই একটা ঘটনা ছিল। এটি এমন একটি উৎসাহব্যঞ্জক, প্রেরণাদায়ক এবং আনন্দময় ঘটনা ছিল, যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’

বাংলাদেশ ও ভুটানের যোগসূত্রকে ‘অত্যন্ত প্রাচীন’ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাধারণ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ঐতিহ্য এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় আজ আমাদের সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো বাণিজ্য, পর্যটন, জলবিদ্যুৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, স্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষি, আইসিটি, শিক্ষা, জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এ চুক্তি কার্যকর হওয়ার পরে বাংলাদেশের জনগণ ভুটানের তরতাজা আপেল, কমলালেবুসহ অন্যান্য তাজা ফলমূল ও শাকসবজি গ্রহণের সুযোগ পাবে এবং ভুটানের ফ্যাশনসচেতন মানুষ বাংলাদেশ থেকে আরও মানসম্মত পোশাক নিতে পারবেন। বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্পগুলো ভুটানের পাথর ব্যবহারে লাভবান হতে পারে এবং বাংলাদেশে ওষুধগুলো ভুটানের স্বাস্থ্য খাতে অবদান রাখতে পারে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের চিলমারী বন্দরের উন্নয়ন করছি, নারায়ণগঞ্জের পানগাঁও ভুটানের জন্য উন্মুক্ত। শুধু তাই নয়, আমাদের তিনটি বন্দর চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা ভুটান চাইলে ব্যবহার করতে পারবে। আমাদের সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে এর উন্নয়ন করা হচ্ছে, যা ভুটানের জন্য উন্মুক্ত।’

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং তাঁর ভাষণে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ এবং বঙ্গবন্ধৃ শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) প্রায় ১০ বছর অধ্যয়নকালীন বাংলাদেশে অবস্থানের কথা স্মরণ করে বাংলাদেশকে তাঁর ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে উল্লেখ করেন। আজ সকালেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপে তাঁর প্রতি মাতৃত্বসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপনের প্রাক্কালে ইতিহাসের অংশ হতে পারায় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরে তাঁর প্রতি প্রদর্শিত আতিথেয়তা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতারই বহিঃপ্রকাশ বলেও লোটে শেরিং উল্লেখ করেন।

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সব সময়ই ভুটানের পাশে থেকেছে। আর এই চুক্তি স্বাক্ষরই ভুটানকে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণে বাংলাদেশের স্বীকৃতি।’