বাংলাদেশের সামনে এখন দুটি বিকল্প

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজের নতুন বই নিখোঁজ গণতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদের পথরেখা ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। বইটির শেষ অধ্যায়ের শেষ কিস্তি

নিখোঁজ গণতন্ত্র: কর্তৃত্ববাদের পথরেখা ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আলী রীয়াজ। প্রথমা প্রকাশন, মার্চ ২০২১

দৃশ্যকল্প বা সিনারিও বিবেচনা করলে বাংলাদেশের সামনে এখন দুটি বিকল্প আছে—প্রথমত বর্তমান পথরেখাকে অব্যাহত রাখা, যার সম্ভাব্য পরিণতি হচ্ছে প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ববাদ। দ্বিতীয়ত, এই পথ থেকে সরে এসে একটি অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়া, যা ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে অগ্রসর হবে। যেকোনো ধরনের দৃশ্যকল্প বিবেচনার সময় এটা মনে রাখতে হবে যে কোনো সমাজের বা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত নয়। যেকোনো ধরনের ভবিষ্যৎ পথরেখা তৈরি করার বিষয়। একটি দেশের নাগরিকেরা যত বিরূপ পরিবেশই মোকাবিলা করুন না কেন, ভবিষ্যৎ তাঁরাই তৈরি করেন। নাগরিকদের সক্রিয়তা বা নিষ্ক্রিয়তাই হচ্ছে পথরেখা নির্ধারণের মূল চালিকা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইতিহাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্মিত হয় না, আর রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবী বলে কিছু নেই।

প্রথম দৃশ্যকল্প বোঝার জন্য বিবেচনায় নেওয়া দরকার যে দো-আঁশলা ব্যবস্থাগুলো পৃথিবীর অন্যত্রও একধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে; হাইব্রিড রেজিমগুলো যে সব সময় নিশ্চল, তা নয়। এগুলোর এক বড় অংশই পরিবর্তিত হয়েছে। কম্বোডিয়া গত এক দশকে একটি দো-আঁশলা ব্যবস্থা থেকে এমন এক জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছে যে একে এখন কর্তৃত্ববাদী দেশ হিসেবেই গণ্য করা হচ্ছে। দো-আঁশলা ব্যবস্থা থেকে কর্তৃত্ববাদে উপনীত হওয়ার জন্য নাটকীয় পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। ক্ষমতার ক্রমাগত এককেন্দ্রীকরণ এবং ক্ষমতাকাঠামোতে রাষ্ট্রের নিপীড়ক শক্তিগুলোর আধিপত্যই একটি দেশকে কর্তৃত্ববাদের দিকে অগ্রসর করে দেয়। বাংলাদেশ সেই পথে অগ্রসর হবে কি না, সেটা ক্ষমতাবলয়ের গঠন থেকেই অনুমান করা সম্ভব।

দ্বিতীয় দৃশ্যকল্প তখনই বাস্তবায়িত হবে, যখন ক্ষমতাসীন দলের থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। দলের নেতৃত্বে সেটা বোঝার এবং পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তে ফিরে যাওয়ার জন্য তাগিদ অনুভব না করা পর্যন্ত এই পথরেখার কোনো সম্ভাবনা নেই। সেই তাগিদ তৈরির প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে দেশের বিরোধী দলগুলোর এবং জনসমাজ বা সিভিল সোসাইটির।

শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়

গত এক দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে ব্যাপক ক্ষয় হয়েছে, প্রতিষ্ঠানসমূহ যেভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, বিরাজনীতিকরণের পরিসর যেভাবে সর্বব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে, সেই বিবেচনায় এই ধারাকে উল্টে দেওয়ার কাজ সহজ হবে বলে মনে করার কারণ নেই। এ অবস্থা থেকে সরে আসার জন্য প্রথমেই দরকার হবে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা। এটা ঠিক যে নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়; কিন্তু সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা রক্ষা কোনোটাই সম্ভব নয়। আমাদের আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ ধরনের নির্বাচনে উৎসাহী নয়, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন যেসব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তার একটিও এই ধরনের নির্বাচনের জন্য অনুকূল নয়। যদিও বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ, অন্যান্য আইন এবং বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের দেওয়া রায় থেকে এটা স্পষ্ট যে দেশের নির্বাচন কমিশনের হাতে যে ধরনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু বাস্তবে এই ক্ষমতার প্রয়োগ সীমিত, আর তার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিরাজমান শাসনব্যবস্থা। এই গ্রন্থের আলোচনায় আমরা বারবার দেখেছি যে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের সময়ে দলীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরে এ দেশে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়নি। অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। বিরাজমান অবস্থায় ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার পাঠানো চিঠির কথা স্মরণযোগ্য। তিনি জাতিসংঘের মহাসচিবকে নির্বাচন ‘মনিটরিং’–এর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২০০৭ সালের ৬ জানুয়ারি দেশে ব্যাপক রাজনৈতিক সংকটের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি কার্যত জাতিসংঘের অধীনে নির্বাচন করার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহের কথা জানান। নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশনের সংস্কার বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল এবং তার মিত্ররা অতীতে যেসব প্রস্তাব দিয়েছেন, সেগুলোর বাস্তবায়নই সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম করতে পারে। ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই ১১ দল, আওয়ামী লীগ, জাসদ ও ন্যাপের পক্ষ থেকে দেওয়া ৩০ দফা সংস্কার প্রস্তাবে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কার্যপদ্ধতির কথা বলা হয়েছে।

সংস্কার প্রস্তাবে উৎসাহের ঘাটতি

কিন্তু এটা সহজেই বোধগম্য যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একসময় যেসব দাবি করেছিল বা সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিল, সেগুলোর ব্যাপারে তাদের উৎসাহের ঘাটতি আছে। সেই কারণে এবং অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলা যায় যে বাস্তবোচিত পথ হচ্ছে নির্বাচনের সময়ে এমন এক সরকারের উপস্থিতি, যা কোনো অবস্থাতেই নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে না। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের আগপর্যন্ত বিভিন্ন রকমের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা গেছে। ওই ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন কিংবা ওই ধরনের কোনো ব্যবস্থা প্রবর্তন ছাড়া এখন তা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে হয় না। সুতরাং বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে যাঁরা গণতন্ত্রাকাঙ্ক্ষী, তাঁদের সম্মিলিতভাবে এই বিষয়ে আওয়াজ তোলা জরুরি।

কয়েক বছর ধরে গণতন্ত্রের অবনয়ন থেকে কেবল যে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদেরাই লাভবান হচ্ছেন তা নয়। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আমলাতন্ত্রকে যেভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে, তা কাঠামোগতভাবে গণতন্ত্রের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে আনুকূল্যের এই নেটওয়ার্ক দেশের সিভিল সোসাইটির একাংশকে এমনভাবে যুক্ত করতে পেরেছে যে ক্ষমতাসীনদের টিকে থাকার ওপরে এদের স্বার্থ এবং ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই গোষ্ঠীর জন্য ক্ষমতাসীনদের পরাজয়ের মূল্য (কস্ট অব ডিফিট) ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেশি। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচনায় সাম্প্রতিক কালে একধরনের কথাবার্তা প্রচলিত হয়েছে, যাতে অংশগ্রহণকারীরা অত্যন্ত মৃদুভাবে প্রচলিত শাসনব্যবস্থার ‘সীমাবদ্ধতার’ কথা উল্লেখ করেন, গত নির্বাচনগুলো ‘সুষ্ঠু’ভাবে হয়নি তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বীকার করেন কিন্তু তার দায়ভার প্রধানত বিরোধী দলের ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, অথবা এক অনির্ধারিত ‘ভবিষ্যতে’ এসব ‘দুর্বলতা’ কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এ কথা তারা বলতে নারাজ যে নাগরিকের বাক্-ব্যক্তি-মতপ্রকাশ-সমাবেশ-আইনের চোখে সমতার অধিকার হরণের বিষয় বিরোধীদের আচরণের ওপরে নির্ভরশীল হওয়ার কথা নয়। বিরোধী দলের সীমাবদ্ধতা এবং ব্যর্থতার ফল দল বা দলগুলো অবশ্যই বহন করবে, কিন্তু তার দায় ক্ষমতাসীন দল কেন নাগরিকদের ওপরে চাপিয়ে দিচ্ছে, কেন নাগরিকদেরই তাদের অধিকার—এমনকি মৌলিক অধিকার এবং ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন এ ধরনের আলোচকেরা করতে রাজি নন। এই প্রশ্ন করার দায়িত্ব যাঁদের, সমাজের সেই শ্রেণি ‘ক্ষমতাসীনদের পরাজয়ের মূল্য’ বিবেচনা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাঁদের মধ্যে এই প্রবণতাও লক্ষণীয় যে তাঁরা পরোক্ষভাবে এই ধারণাকেই সমর্থন করেন যে গণতন্ত্র বাছবিচার করে প্রযুক্ত হওয়ার বিষয়, ‘কারও জন্য গণতন্ত্র, কারও জন্য নয়’ যে আসলে গণতন্ত্রই নয়, সেটা হয় তাঁরা উপলব্ধি করতে অপারগ কিংবা অনীহ। ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার দায় বিরোধীদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে কিংবা এই বিষয়ে মৌনতার মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে বৈধতা দেওয়া হয়।

* ক্ষমতার ক্রমাগত এককেন্দ্রীকরণ এবং ক্ষমতাকাঠামোতে রাষ্ট্রের নিপীড়ক শক্তিগুলোর আধিপত্যই একটি দেশকে কর্তৃত্ববাদের দিকে অগ্রসর করে দেয়। * নির্বাচনের সময় দলীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরে এ দেশে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়নি। * গণতন্ত্রাকাঙ্ক্ষীদের সম্মিলিতভাবে আওয়াজ তোলা জরুরি।

শুধু তা-ই নয়, এই আলোচনা প্রায়ই শোনা যায় যে যেহেতু এই মুহূর্তে কোনো ‘বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি’ অনুপস্থিত, তাতে করে এই ব্যবস্থাই এখন জারি থাকা সঠিক। এ ধারণার অন্তঃসারশূন্যতার দিক হচ্ছে এখানে যে গণতন্ত্রের জন্য আলাদা করে কোনো বিকল্প শক্তির আবির্ভাব ঘটে না, প্রতিদিনের গণতন্ত্রের মধ্য দিয়েই আরও ভালো গণতন্ত্রের শক্তি তৈরি হতে পারে। অগণতান্ত্রিক শাসন যেকোনো ধরনের গণতান্ত্রিক বিকল্পের সম্ভাবনাকেই দুর্বল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিরোহিত করে। প্রলম্বিত কর্তৃত্ববাদী শাসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গণতান্ত্রিক শক্তিই। উদার গণতন্ত্র, এমনকি নির্বাচনী গণতন্ত্রের একটি দিক এই যে গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে যাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ, তারাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু যেখানে অগণতান্ত্রিক শাসন বিরাজমান, সেখানে গণতান্ত্রিক শক্তি বা যাঁরা গণতন্ত্রের আন্দোলনে ও চর্চায় ভূমিকা রাখতে পারেন, তাঁরাই আগে অধিকারবঞ্চিত হন, ফলে ‘বিকল্প’ হিসেবে এমন শক্তির বিকাশের সম্ভাবনাই বেশি, যাঁরা গণতন্ত্রের আদর্শের ওপরে ভিত্তি করে বিকশিত হচ্ছে না শুধু তা–ই নয়, তাঁরা আদর্শিকভাবেও গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি নন। একেবারে সঠিক রাজনৈতিক বিকল্পের কথা যাঁরা বলেন, তাঁদের আকাঙ্ক্ষার দিকটি বাদ দিলে যা দেখা যায় তা হচ্ছে হয় তাঁরা এই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই প্রলম্বিত করছেন নতুবা এমন শক্তির উত্থানের অনুকূলে পরিবেশ তৈরি করছেন।

গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা

বর্তমান ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনদের অনুসৃত কৌশল হচ্ছে বলপ্রয়োগ, কো-অপটেশন এবং (স্থানীয় পর্যায়ে) নির্বাচন। ক্ষীণকায় সিভিল সোসাইটি এবং বিরোধী দলগুলো এই তিনটির বৃত্তচক্রেই অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে পরিবর্তন ঘটেছে, সে বিষয়ে উপলব্ধি ছাড়া গণতন্ত্রের এই সংকট মোকাবিলা এবং তা থেকে উত্তরণের পথ বের করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের প্রকৃতি, গভীরতা এবং তার ব্যাপ্তি বিষয়ে ধারণার অভাবের কারণেই কৌশল তৈরির ক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলো সব সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে আছে।

বিরোধী দলগুলোর ভেতরকার অনৈক্য আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। দলগুলো যে অভ্যন্তরীণভাবেও বিভিন্ন মতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, সেটা সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির দিকে তাকালেই এ বিষয়টি বোঝা সহজ হয়। বিএনপির নেতৃত্বের ক্ষেত্রে শূন্যতার বিষয় নিয়ে ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ সালে সোহরাব হাসানের বিশ্লেষণ উল্লেখযোগ্য, ‘বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে (নির্বাহী আদেশে বর্তমানে জেলের বাইরে থাকলেও তিনি প্রকাশ্য রাজনীতি করতে পারছেন না) বিএনপি কে চালাচ্ছেন, তা-ও দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের কাছে পরিষ্কার নয়’। তদুপরি দলের কর্মকৌশল এবং সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি অনুপস্থিত। দলের ভেতরে গণতন্ত্রের অভাব এবং বিভিন্ন বিষয়ে—যেমন জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক কিংবা অতীতের ভুলত্রুটির দায়িত্ব নেওয়া—দলের অবস্থান স্পষ্ট নয়। অন্যান্য দলের পক্ষ থেকে এই সংকট মোচনের জন্য যে কর্মসূচি ও বক্তব্য উপস্থাপিত হয়, তাতে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের বিষয়েই গুরুত্ব দেওয়া হয়, আশুকরণীয়র দিকনির্দেশনা অস্পষ্ট।

সোহরাব হাসান লিখেছেন, ‘অনেকে মনে করেন, বিএনপি মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করার কারণে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। বিএনপির নেতাদের দাবি, সরকারের দমন-পীড়নের কারণে যেখানে তাঁরা রাস্তায় নামতে পারছেন না, সেখানে আন্দোলন গড়ে তুলবেন কীভাবে? তাঁদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে অতীতে কোনো সরকারই বিরোধী দলকে জামাই আদরে রাখেনি। জেল-জুলুমের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই বিরোধী দলকে আন্দোলন করতে হয়।’ প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৯৬০ সাল থেকে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত ৩২৩টি আন্দোলন বিশ্লেষণ করে এরিক চেনোওয়েথ এবং মারিয়া স্টেফান দেখান যে অহিংস আন্দোলনগুলো অধিক মানুষকে যুক্ত করতে সক্ষম হয় এবং সেগুলো সাফল্যও অর্জন করে বেশি। তাঁদের গবেষণা বলছে যে বড় ধরনের অহিংস আন্দোলন পাঁচটি কারণে সাফল্য অর্জন করে। প্রথমত, ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে স্বাভাবিকতায় ব্যাঘাত ঘটায় ক্ষমতাসীনদের সমর্থকেরা তাঁদের স্বার্থ এবং পছন্দ পুনর্বিবেচনা করেন এবং অনেক সময় তাঁদের সমর্থন পরিবর্তন করেন। দ্বিতীয়ত, বড় ধরনের অহিংস আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকারি নিপীড়ন সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে যায়, বিশেষ করে যেকোনো ধরনের সহিংস আন্দোলনের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থার তুলনায়। তৃতীয়ত, বড় ধরনের অহিংস আন্দোলনের আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের সম্ভাবনা বেশি, এতে করে ক্ষমতাসীনেরা তাদের প্রধান আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমর্থকদের কাছ থেকে সমর্থন হারায়। চতুর্থত, বড় আকারের অহিংস আন্দোলন সরকারের নিপীড়নের মুখেও টিকে থাকতে পারে। পঞ্চমত, বিভিন্ন ধরনের নতুন কৌশল অবলম্বন করে বড় আকারের অহিংস আন্দোলন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তাঁরা এ বিষয়ে অন্য এক গবেষণায় দেখান যে মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ অংশগ্রহণ করলে একটা আন্দোলন সফল হবে বলে ধরে নেওয়া যায়।

শুধু এই গবেষণাই নয়, বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয় যে ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই কেবল এ ধরনের একটি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব। বৈশ্বিক রাজনীতিতে পরিবর্তন এবং গণতন্ত্রের সংকটের মাত্রার ব্যাপকতা গণতন্ত্র রক্ষা এবং পুনরুদ্ধারের জন্য কৌশলের পরিবর্তনের প্রয়োজন সৃষ্টি করেছে, কিন্তু এটি সর্বজনীন গণতন্ত্রের যে আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে এখনো আছে, তাঁদের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই তার প্রতিষ্ঠা বা পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব।

(স্থানাভাবে তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হলো না। লেখকের বইয়ে সূত্র যথাযথভাবে উল্লেখিত রয়েছে)