
ছেঁউড়িয়া। ছোট্ট একটি গ্রামের নাম। নামটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। যার পেছনের মানুষ ফকির লালন শাহ। দিন যত যাচ্ছে, ততই ছড়াচ্ছে এই গ্রামের নাম। বছরের সব সময় এই গ্রামের লালন আখড়াবাড়িতে জড়ো হন তাঁর ভক্ত-অনুসারীরা। তবে দুটি সময়ে এখানে লাখো ভক্ত-অনুসারী ও দর্শনার্থীর ভিড়ে তিল পরিমাণ জায়গা থাকে না। তার একটি হলো এই দোলপূর্ণিমা।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে সেখানে শুরু হয়েছে তিন দিনের উৎসব। লালন একাডেমি ও জেলা প্রশাসনের আয়োজনে এর নাম দেওয়া হয়েছে লালন স্মরণোৎসব। ৩৫ বছর ধরে এই আখড়াবাড়িতে আসছেন ঝিনাইদহ থেকে বশির বাউল। তাঁর মতে, দোলপূর্ণিমা তিথিতে লালন সাঁই এই আখড়াবাড়িতে তাঁর গুরু সিরাজ সাঁইয়ের কাছ থেকে খিলাফত নিয়েছিলেন। তাই দিনটাকে মধুময় ও আনন্দময় করে তুলতে প্রতি দোলপূর্ণিমা তিথিতে গানের আসর বসাতেন সাঁইজি। সেই থেকে শুরু। দিন যত যাচ্ছে, ভক্ত-অনুসারীদের ভিড় তত বাড়ছে। গানে গানে তাঁকে (সাঁইজি) মনের ভেতর গেঁথে নিচ্ছে।
এই ছেঁউড়িয়ায় আখড়াবাড়ির পাশেই বয়ে চলেছে কালী নদী। কালের কশাঘাতে পড়ে সেটি পদে পদে বাধা পেয়ে আটকে গেছে। তাই কেউ বলেন এটা মরাকালী নদী, আবার কেউ বলেন গতিহারা কালী নদী। এখন সেখানে বাউল, সাধু, ফকির আর সাধারণ দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর। সারা দেশ থেকেই বিপুলসংখ্যক লালনভক্ত, অনুসারী আসন পেতেছেন একাডেমি ভবনের নিচতলাসহ আখড়াবাড়ি চত্বর ও সামনের মাঠে। সাধুসঙ্গ, বাউলগান আর তত্ত্ব আলোচনায় সময় পার করছেন বাউল অনুসারী সাধুরা।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার মুহূর্তে লালন আখড়াবাড়ির খালি জায়গা মানুষে মানুষে ভরে গেল। সাদা-সফেদ পোশাকসহ নানা বেশধারী বাউল মানুষের জটলা আশপাশের এলাকায়। দেশের নানা প্রান্ত ছাড়াও ভারতীয় একদল পর্যটক ও বাউলসাধুর সেখানে দেখা মিলল। সেখানে ছোট ছোট আসন করে অবিরাম চলছে লালনের গান। গানে মজেছেন দর্শনার্থীরাও। সাধারণ দর্শনার্থীদের অনুরোধেও গান পরিবেশন করেছেন বাউলেরা।
প্রবীণ বাউলেরা জানান, দোলপূর্ণিমার অনুষ্ঠান চলে আসছে শত বছরের বেশি সময় ধরে।
বাউলেরা বলেন, ‘দোলপূর্ণিমার রাতে ফকির লালন তাঁর শিষ্যদের নিয়ে গানের আসর বসাতেন। সেখানে নতুন নতুন অনেক গান পরিবেশন করতেন ফকির লালন। শিষ্যদের বলতেন, ‘পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে।’
লালন গবেষক এ কে এম আজাদুর রহমান মনে করেন, ‘মানুষের মাঝ থেকে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে সেতুবন্ধ তৈরি করে এই মানুষেরা। বাউলেরা তাঁদের মতো চলতে পছন্দ করেন। ফকির লালন মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ তৈরি করেননি। আজকের সমাজে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বেড়েছে, বেড়েছে হানাহানি। লালন বলেছেন, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’
ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে লাখো মানুষ সাঁইজির সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন এ স্মরণোৎসবে। আউল-বাউল, সাধু-বৈষ্ণব আর ফকির-দিওয়ানাদের পদভারে মুখর হয়ে উঠেছে সাঁইজি ধাম। ধামের পাশে বিশাল মাঠের খোলা প্রান্তরে গুরু-শিষ্যের মিলনমেলায় ভক্তদের চলছে নাচে-গানে দিনরাত ভাবের খেলা। স্মরণোৎসব বা দোল উৎসব মানেই বাউল ফকিরদের মহাসম্মেলন।
সন্ধ্যায় কালী নদীর পাড়ে গতকাল মূল মঞ্চে তিন দিনের আয়োজনের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ আসনের সাংসদ মাহবুব উল আলম হানিফ। জেলা প্রশাসক জহির রায়হানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য শাহিনুর রহমান। তিনি বলেন, লালনের মানবতাবাদী দর্শন দেশে এবং বিদেশেও সন্ত্রাস, যুদ্ধবিগ্রহ নির্মূল করতে পারে। জাতি-ধর্ম-বর্ণকে মিলিয়ে মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।