বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশপ্রেমিক ও নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশের ইতিহাস জানতে হবে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই তাদের ইতিহাস জানতে হবে। তিনি আজ রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নবনির্মিত বহুতল ভবন উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যেন জানতে পারে কত মহান ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সেই স্মৃতিচিহ্নগুলো তারা দেখবে। সেই স্মৃতিগুলি তারা উপলব্ধি করবে, অন্তরে ধারণ করবে এবং সেভাবেই নিজেদের চরিত্রকে গঠন করবে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ইনশা আল্লাহ এই দেশ এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এ দেশের চেতনাকে সমুন্নত রাখবে। কাজেই এই স্মৃতিগুলো ধরে রাখা জাতীয় প্রয়োজন বলেই আমি মনে করি। সে জন্য আমি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আমি শুধু এটুকুই বলব—আমাদের লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা। লাখো শহীদের এই রক্ত কখনো বৃথা যেতে পারে না। বৃথা যায় না। জাতির পিতা বলেছিলেন ‘বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’। বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, পারবেও। বিশ্বে আমরা মর্যাদাপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করব।’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা নতুন প্রজন্মের মানুষের চরিত্র গঠনের জন্যই জরুরি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পর এমন একটা সময় এসেছিল, যখন যারা মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান—এটা বলতে ভয় পেত। এটুকু বলতে আতঙ্কগ্রস্ত হতো, দ্বিধাগ্রস্ত হতো। আর যারা সম্পূর্ণ দালালিটা করতে পেরেছে তাদের কথা আলাদা। আমি অন্তত এটুকু দাবি করতে পারি যে ২১ বছর পর সরকার গঠন করে আমাদের গৃহীত পদক্ষেপে মুক্তিযোদ্ধারা গর্ব করে বলতে পারেন—আমি মুক্তিযোদ্ধা।’

একটা সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে গিয়ে বহু নেতা-কর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে—উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের ছুরি মারা হয়েছে। সমাজে তারা নানাভাবে অত্যাচারিত-নিগৃহীত হয়েছে। এমনকি জাতির পিতার ছবি প্রচার হতো না টেলিভিশনে। জাতির পিতার ছবি থাকলে সেই ছবিকে কৌশলে ঢেকে প্রচার করা হতো, এমনকি আঙুল দিয়ে ঢেকে রাখতেও দেখা গেছে।’ এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘সত্য কোনো দিন চাপা থাকে না। সত্যের শক্তি অনেক বেশি। আজকে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা ফিরে এসেছে।’

অনুষ্ঠানের শুরুতে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন ছায়ানটের শিল্পীবৃন্দ। পরে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারে নিহত জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা দুই লাখ মা-বোনের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তৃতা করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। সংস্কৃতি-বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী জাদুঘর চত্বরে শিখা অম্লান প্রজ্বলন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ফলক উন্মোচনের পর পুরো জাদুঘর ঘুরে দেখেন।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গতকালই সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পুরাতন ভবন থেকে পুরোনো-নতুন প্রজন্মের ৭১ জন মিলে পায়ে হেঁটে সেখান থেকে শিখা অম্লান নিয়ে এসে জাদুঘরের প্রবেশ মুখে কালো মার্বেল পাথরের গণ্ডির মধ্যে পুনঃস্থাপন করেন। এর ঠিক ওপরেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত একটি যুদ্ধ বিমান এবং হেলিকপ্টার প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে।

আগারগাঁওয়ে প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর নয় তলা এই জাদুঘর ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর আয়তন প্রায় ১ লাখ ৮৫ হাজার বর্গফুট। ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০২ কোটি টাকা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্র থেকে শুরু করে ব্যবহার্য জিনিসপত্র, একাত্তরের নানা দলিলপত্র, বার্তা, চিঠি মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার নিদর্শন রাখা হয়েছে।

১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ ঢাকার সেগুনবাগিচায় একটি ভাড়াবাড়িতে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়।