বাজারে নিত্যপণ্যের দামের উত্তাপ চলছেই। ক্রেতাদের বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে তরিতরকারি। বেড়েছে মাছের দাম। ফলে উধাও হয়ে গেছে ক্রেতার স্বস্তি।
বছরের এই সময়টায় এমনিতেই সবজির দাম একটু চড়া থাকে। ক্রেতাদেরও এতে গা সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু এবারের অবস্থা অন্যান্য সময়ের চেয়ে খারাপ।
টানা ভারী বর্ষণে দেশের সবজি উৎপাদনকারী বিভিন্ন জেলায় ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক সবজি পচে গেছে। আবার কয়েক জায়গায় বন্যার কারণে ফসলের খেত ভেসে গেছে। এসব কারণে ঢাকায় সবজি আসছে কম। তাই দামও বেড়ে গেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কোনো কোনো সবজির দাম গত ১০-১২ দিনে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আবার ভারতীয় পেঁয়াজের প্রভাবে বেড়েছে দেশের বাজারে সব ধরনের পেঁয়াজের দাম। রসুনের দামও বাড়তি। বেড়েছে মসুর ডালের দামও। মাছের বাজারেও আগুন। তবে ব্রয়লার মুরগির দাম কমেছে কেজিপ্রতি ১০-১৫ টাকা।
শুক্রবার জিনিসপত্রের দাম বেশি থাকে বলে বাজার করতে বের হননি সরকারি চাকুরে পূর্ব রামপুরার বাসিন্দা আরিফ হোসেন। শনিবার সকালে যান রামপুরা বাজারে। আধঘণ্টা বাজার ঘুরে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘শনিবার এসেও তো কোনো লাভ হলো না। জিনিসপত্রের দাম তো কমছে না।’
আরিফ হোসেনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় ওই বাজারেই। জানালেন, একসঙ্গে পুরো মাসের মাছ কেনা তার অভ্যাস। কিন্তু আজ (শনিবার) তিনি শুধু সোয়া এক কেজি ওজনের একটি রুই এবং আধা কেজি চিংড়ি কিনেই বাসায় ফিরেছেন। সঙ্গে কিনেছেন কয়েক ধরনের সবজি।
তরিতরকারি: রামপুরা ও কারওয়ান বাজাের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল বাজারে চিচিঙা, বেগুন, ঝিঙে, ঢ্যাঁড়স, করলা বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৬০ টাকায়। ১০-১২ দিন আগেও এসব সবজি কেনা যেত ৩৫-৪০ টাকার মধ্যে।
দাম বেশি বেড়েছে কাঁচা পেঁপে আর চালকুমড়ার। ১০ দিনের ব্যবধানে এর দাম হয়ে গেছে দ্বিগুণ। এখন ৪০ টাকার নিচে পেঁপে কিংবা চালকুমড়া কেনা যায় না।
বাজারে শসা ৪০-৪৫, ধুন্দুল ৫৫-৬০, পটোল ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে পটোল ১০ দিন আগেও বিক্রি হতো ৩০-৩৫ টাকায়, ধুন্দুল ৪০-৫০ টাকায়। কাঁচা মরিচের কেজি ৮০-১০০ টাকা। তবে আড়াই শ গ্রাম কিনলে গুনতে হবে ২৫-৩০ টাকা।
কারওয়ান বাজারের আড়তদার দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আগে সাভার থিকা গাড়ি গাড়ি মাল আইতো। এখন এক পিকআপ ভরতে কষ্ট হয়। দাম বাড়ব না ক্যা।’
ঢাকায় সবজির বড় বাজার কারওয়ান বাজারের আড়তমালিকেরা বলছেন, এই বাজারে যত সবজি আছে, তার বড় অংশই আসছে যশোর আর খুলনা অঞ্চল থেকে। উত্তরবঙ্গ থেকে সবজি আসছে কম। অন্যান্য সময় উত্তরবঙ্গ থেকে আসা সবজিতেই কারওয়ান বাজার ভরে যায়।
আরেক বড় পাইকারি বাজার শ্যামবাজারে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ৪০-৫০টি সবজিবাহী ট্রাক আসে। এখন আসছে ২০-২৫ ট্রাক। শ্যামবাজারে সবজির একটি বড় অংশই আসে নদীপথে, লঞ্চ ও ট্রলারে করে। নদীপথেও এখন সবজি কম আসছে।
শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতির সভাপতি মো. সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন জায়গায় টানা বৃষ্টি ও বন্যার কারণে সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। পচে গেছে। সে কারণে সবজির সরবরাহ এখন কম। তাই দামও বেড়েছে।
পেঁয়াজ-রসুন-আদা: ভারত সরকার নিজের দেশের বাজার ঠিক রাখতে পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য বাড়িয়েছিল জুনে। তার প্রভাবে আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দেশীয় পেঁয়াজের দাম। অথচ, দেশি পেঁয়াজের সর্বশেষ ফলন উঠেছে এপ্রিলে। ফলন ভালো হয়েছে, বড় ধরনের মজুতও আছে। এই পেঁয়াজের কোনো সংকটও নেই।
খুচরা বাজারে এখন দেশি পেঁয়াজের কেজি ৬০-৬৫ টাকায় ঠেকেছে। অথচ ৮-১০ দিন আগেও এই পেঁয়াজ বিক্রি হতো ৪৫-৫০ টাকায়। বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজের কেজিও ৬০-৬৫ টাকা। এর দাম ছিল ৪০-৪৫ টাকা।
বাজারে গতকাল দেশি রসুন বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায়। তবে চীনা রসুনের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। এর দাম ১২০ টাকা কেজি। আদা আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে, কেজিপ্রতি ১৬০ টাকা।
মাছ-মাংস: বাজারে মাছের সরবরাহ কম। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের মাছে কেজিতে ২০-৫০ টাকা বেড়েছে। আর এক কেজি ওজনের ইলিশ কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত। মাঝারি ইলিশ (৫০০-৭৫০ গ্রাম) ৫০০-৮০০ টাকা।
ঢাকায় মাছের বড় আড়ত যাত্রাবাড়ী মৎস্য আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, মাছের সরবরাহ কমে যাওয়ায় দামও বেড়েছে। সরবরাহ কমে যাওয়ার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন তিনি। প্রথমত, দেশের মাছের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ পূরণ করা কাপ্তাই লেকে দুই মাস ধরে মাছ ধরা বন্ধ। আরও এক মাস বন্ধ থাকবে। দ্বিতীয়ত, হাওর-বাঁওড়-বিল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মাছ ভেসে গেছে। তৃতীয়ত, কয়েক দিন আগ পর্যন্ত সমুদ্রে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত থাকায় সামুদ্রিক মাছ ধরা যায়নি।
বাজারে গরুর মাংস এখনো চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে। কেজি ৩৮০ টাকা। খাসির মাংসের কেজি ৫২০-৫৫০ টাকা।
আগের সপ্তাহ থেকেই ডিমের দাম বাড়ছিল। গতকাল ফার্মের মুরগির ডিমের হালি বিক্রি হয়েছে ৩৪-৩৬ টাকা। তবে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০-১৫ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ১৩৫-১৪৫ টাকায়।
অন্যান্য: দুই সপ্তাহ ধরেই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে মসুর ডাল। দেশি ডাল বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩০ টাকা কেজি দরে। নেপালি ডালের কেজি ১৩০-১৩৫ টাকা। এই দুই ধরনের ডাল আগে ১১৫-১৩০ টাকায় বিক্রি হতো। বড় দানার মসুর ডালের কেজি এখন ১০০-১১০ টাকা, আগে দাম ছিল ৯০-১০৫ টাকা। মুগ ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকায়।
বাজারে চাল, ভোজ্যতেল ও চিনির দামে তেমন হেরফের হয়নি। বিক্রি হচ্ছে আগের দামেই।