বাদল রহমানের সময়কে জানাবে যে বই

বাদল রহমান
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে প্রথম ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সের পরিকল্পক ও সমন্বয়ক ছিলেন বাদল রহমান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগ দেন এবং সক্রিয় হন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ কার্যক্রমে। স্বাধীনতার পরই দেশে চলচ্চিত্র সংসদ কার্যক্রমে জোয়ার আসে। একের পর এক গড়ে ওঠে চলচ্চিত্র সংসদ। এমনকি সেগুলোর মোর্চা ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল বাদল রহমানের।

মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্রকার, লেখক ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বাদল রহমানের ১২তম প্রয়াণদিবস ছিল ১১ জুন। ২০১০ সালের ওই দিনে ৬২ বছর বয়সে প্রয়াত হন তিনি। বাদল রহমান বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’র নির্মাতা এবং চলচ্চিত্র শিক্ষক ছিলেন। চলতি মাসের ৪ জুন ছিল তাঁর ৭৩তম জন্মদিবসও। বাদল রহমানের জন্ম ও প্রয়াণদিবস উপলক্ষে ১১ জুন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সম্মেলনকক্ষে একটি স্মরণসভার আয়োজন করে ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি। সেখানে মোড়ক উন্মোচন করা হয় ‘মুখোমুখি বাদল রহমান’ বইটির। এটি মূলত চলচ্চিত্রকার বাদল রহমানের সাক্ষাৎকারের বই। এখানে পাওয়া যাবে অকপট এক বাদল রহমানকে, যিনি জীবনের গোড়া থেকে চলচ্চিত্র আন্দোলনে জড়িয়ে যাওয়ার কাহিনিসহ নানা ঘটনা আড্ডাচ্ছলে প্রকাশ করেছেন অনুজ সহযোদ্ধার কাছে। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুনকে। শোনা যাক তাঁর কাছ থেকে।

‘বাদল ভাইয়ের সঙ্গে নির্মল আড্ডা থেকে শুরু হয় এই সাক্ষাৎকার গ্রন্থ। তাঁর সম্পর্কে এত বিস্তারিত তথ্য আর কোথাও পাওয়া যাবে না। এর একটি রেকর্ডও আমার কাছে আছে, যা ব্যবহার করে আমি একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছি। আমার দুঃখ একটাই, বাংলাদেশে বাদল রহমানের আজ যে অবস্থানে থাকার কথা, সেখানে তাঁকে রাখা হয়নি। অথচ তাঁর অবদান অনেক।’ ‘মুখোমুখি বাদল রহমান’ বইতেও একই আক্ষেপ করেছেন বেলায়াত হোসেন মামুন। লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতি অদ্ভুত এক অবস্থায় রয়ে গেছে। এই দেশে এখনো একজন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট মানুষকে সমাজে ন্যূনতম গুরুত্ব পেতে হলে দ্রুত একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র নির্মাণ করতে হয়।’

১৯৬৭ সাল থেকে রেডিওর পাশাপাশি টেলিভিশনে ছোটদের অনুষ্ঠানের চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন বাদল রহমান। জড়িয়ে যান সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তাঁকে বলেছিলেন, মানুষের কথা বলতে হলে তাঁকে বড় পর্দায় আসতে হবে। তিনি জহির রায়হানের সঙ্গেই সেই কাজ শুরু করতে চেয়েছিলেন। জহির তাঁকে পাঠান মমতাজ আলীর কাছে, যাঁর সহকারী পরিচালক হিসেবে ‘নতুন নামে ডাকো’ সিনেমায় কাজ করেন বাদল। কীভাবে প্রোডাকশন ডিজাইন করতে হয়, কীভাবে করতে হয় সিনেমার পরিকল্পনা, বাদল সেসব শিখেছিলেন মমতাজ আলীর কাছ থেকে। সে প্রসঙ্গে বাদল বলেছেন, ‘চলচ্চিত্রের কারিগরি বিষয়ে যদি কিছু শিখে থাকি, সেটা মমতাজ আলী সাহেবের কাছ থেকে। তিনি অসম্ভব গুণী একজন মানুষ ছিলেন।’

গত শতাব্দীর ষাটের দশকের উত্তাল রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং পরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাদল কখনো ছিলেন কর্মী, কখনো সম্মুখসারির সাংস্কৃতিক নেতা ও সংগঠক। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রসারে তিনি রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তিনি আজীবন নিজেকে দেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে নিযুক্ত রেখেছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়।

চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও সংগঠক বেলায়াত হোসেন মামুনের সাক্ষাৎকারগ্রন্থ ‘মুখোমুখি বাদল রহমান’-এ জ্যেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার বাদল রহমানের সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে তাঁর জীবন এবং বাংলাদেশের পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকের উত্তাল সময়। যে সময়ে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্ত হয়েছে দেশ। এই গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধ, চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির রাজনৈতিক বিচারের প্রশ্নে চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান ব্যক্তিকে ইতিহাসের ঘটনাক্রম থেকে জাতীয় ইতিহাস উন্মোচন করেছেন। মূলত বাদল রহমান ও তাঁর সময়কে জানাবে ‘মুখোমুখি বাদল রহমান’।