‘বাদল সাহেবের’ আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক মালেক

  • মানুষ ভাবতেন গরুর খামার থেকেই তাঁর বিপুল ধনসম্পদপ্রাপ্তি।

  • মেয়ের দাবি মিথ্যা প্রচারণা চলছে, তাঁর বাবার সম্পত্তি পৈতৃক সূত্রে পাওয়া।

আবদুল মালেক
ছবি: সংগৃহীত

ঘটনাটা সেই ডাক্তার জেকিল আর মিস্টার হাইডের গল্পের মতোই। খালি প্রধান চরিত্র দুটি পাল্টে ‘বাদল সাহেব’ আর গাড়িচালক ‘আবদুল মালেক’ ধরে নিলেই হলো। তুরাগের বামনারটেক এলাকার ধনাঢ্য, সদালাপী বাদল সাহেব স্থানীয় লোকজনের কাছে বেশ পরিচিত। তিনিই যে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেক, তা এই সপ্তাহে জানতে পেরেছেন এলাকার মানুষ। এলাকাবাসী জানতেন গরুর খামার থেকেই বাদল সাহেবের এত ধনসম্পত্তি। শহুরে খামারির মডেল হিসেবেও অনেকে তাঁর উদাহরণই দিতেন। বাদল সাহেবের ভালোমানুষি চেহারার আড়ালে রীতিমতো আরেকটা পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিলেন গাড়িচালক আবদুল মালেক। গল্পের জেকিল আর হাইডের মতো একই মানুষের দুটি সত্তা যেন বাস্তবের বাদল আর মালেক। একটা ভালো সত্তা আরেকটা মন্দ।

২০ সেপ্টেম্বর তুরাগ থানার দক্ষিণ কামারপাড়ার বামনারটেক এলাকার নিজের বাড়ি থেকে আবদুল মালেককে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। গ্রেপ্তারের সময় তাঁর কাছ থেকে বিদেশি পিস্তল, ম্যাগাজিন, গুলি, জালটাকা উদ্ধারের কথা জানানো হয়। তা ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত ঢাকার একটি মৌজাতেই মালেক ও তাঁর স্ত্রী নার্গিস বেগমের সাতটি প্লটের সন্ধান পেয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্লটে বহুতল ভবন রয়েছে। আর এসব খবরেই মালেককে নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে সারা দেশের মানুষের। আর খবরটা শুনে প্রথমে এলাকার মানুষের পিলে চমকালেও এখন আড্ডা, চায়ের দোকানে আলোচনা ঘুরেফিরে তাঁকে নিয়েই।

উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টর থেকে বেরিয়ে কিছুটা পশ্চিম দিকে গেলে তুরাগ থানার রানাভোলা ও বামনারটেক এলাকা। এখানে বামনারটেক মূল সড়ক ধরে কিছুদূর এগোলে হাতের ডানে রমজান মার্কেট এলাকায় মালেকের সাততলা বাড়ি। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে যেতে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এগিয়ে আসেন কয়েকজন উৎসুক মানুষ। তাঁরা উল্টো জানতে চান মালেকের দুর্নীতির আরও খবর সম্পর্কে। কেউ নিজে থেকেই অনেক কথা বলেন।

রমজান মার্কেট এলাকায় আবদুল মালেকের সাততলা ভবনটির দুটি আলাদা ফটক। পুরো বাড়িতে ১২টি ইউনিট। এর মধ্যে মালেক থাকতেন তৃতীয় তলায়। গতকাল সকালে বাড়িতে গিয়ে কথা হয় আবদুল মালেকের ছোট মেয়ে নাজনীন সুলতানার সঙ্গে। সবকিছুকে ষড়যন্ত্র দাবি করে নাজনীন বলেন, র‌্যাব তাঁদের ঘর তল্লাশি করে কোনো কিছুই পায়নি। পরে নিজে থেকেই অস্ত্র ও গুলি দিয়ে মামলা সাজিয়েছে। তা ছাড়া তাঁদের ব্যাপারে যেসব সম্পত্তির কথা বলা হচ্ছে, এটাও সঠিক নয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যাপারে ভুল সংবাদ ছড়াচ্ছে। আমার বাবার দুই বিয়ে বা এত সম্পত্তির কথা মোটেও সঠিক নয়। তাঁর সম্পত্তির সবই পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। কিছু বাবার কষ্টের টাকায় করা।’

সড়কের পাশের একটি ওষুধের দোকানের সামনে বসেছিলেন এলাকার প্রবীণ মাতবর অলি মিয়া। প্রায় ৯৩ বছরের অলি মিয়া বলেন, পথেঘাটে দেখা হলে বাদল সাহেব (মালেক) তাঁকে সালাম দিতেন, ভালো–মন্দ জিজ্ঞেস করতেন। তিনিও তাঁকে ভালো হিসেবেই জানতেন। কিন্তু তার আড়ালে এত কিছু আছে, তা শুধু তিনি নন, এ এলাকার কেউ জানতেন না। তাই এখন সবার মুখে তাঁকে নিয়েই কথা।

ওই এলাকা থেকে কিছু দূর গেলে তুরাগের দক্ষিণ রাজাবাড়ী এলাকায় রয়েছে মালেকের গরুর খামার ও তাঁর বাবার নামে মাজার। স্থানীয় লোকজন জানান, গরুর খামারটি ১৯৯৯ সালে এবং তাঁর বাবার মৃত্যুর পর মাজার করেন ২০০৫ সালে। এর মধ্যে মালেক প্রতি শুক্র ও শনিবার মাজার জিয়ারত করতে আসতেন। এলাকার শিশু–কিশোরদের নিয়ে মিলাদ পড়াতেন। একই সময় সেখানে গেলে জড়ো হন এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা। তাঁরাও জানতে চান মালেক সম্পর্কে।

কথা প্রসঙ্গে খামারসংলগ্ন একটি বাড়ির গৃহিণী বলেন, প্রথমে এটা ছিল মুরগির খামার। পরে সেখানে দুই-চারটি গরু তোলা হয়। কিন্তু এরপর কয়েক বছরের ব্যবধানে হঠাৎ করেই খামার বড় হয়ে যায়, গরুর সংখ্যাও বাড়ে। এর মধ্যে গরুর দুধ বিক্রি করে বা খামারের আয় দিয়েই মালেক বাড়ি করেছেন বলে জানতেন। কিন্তু এখন গণমাধ্যমের খবরে তাঁরাও অবাক। আড়ালের এত খবর তাঁরা জানতেন না।