বাধ্য হয়ে এখন দাম নির্ধারণে বিইআরসি

এলপিজি সিলিন্ডার

দেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। দাম কত হবে, নির্ধারণের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হবে, তা ঠিক করতে আজ বৃহস্পতিবার গণশুনানির আয়োজন করেছে সংস্থাটি।

দেশে বেসরকারি খাতে এলপিজির ব্যবসা শুরু হয় ২০ বছর আগে। বেশ কয়েক বছর ধরে বাজারে এর চাহিদা ও ব্যবসার বিস্তৃতি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কিন্তু এত দীর্ঘ সময়েও গ্রাহকের জন্য এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করতে পারেনি। অবশেষে উচ্চ আদালতের নির্দেশে দাম ঠিক করতে উদ্যোগী হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

এর আগে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ক্যাব) এলপিজির মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবিতে ২০১৬ সালে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিল। আদালত গত ২৫ আগস্ট এক মাসের মধ্যে গণশুনানির মাধ্যমে দাম পুনর্নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। তবে বিইআরসি তা পারেনি। পরে আদালতে ক্ষমাও চায় সংস্থাটি। পরে তারা দাম নির্ধারণে উদ্যোগী হয়।

ভোক্তার জন্য একটা সহনীয় মূল্য দেওয়াটাই সবার উদ্দেশ্য। কিন্তু এত দিনেও দাম ঠিক করার জন্য একটা প্রবিধানমালা তৈরি হয়নি। তিনি বলেন, বোঝাপড়ার মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করা হলে সবার জন্য ভালো হবে।
আজম জে চৌধুরী, সভাপতি, এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব)

বিইআরসি সূত্র জানিয়েছে, এলপিজি খাতের কোম্পানিগুলো দাম কত হতে পারে, তা জানিয়ে সংস্থাটির কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। বিইআরসির কারিগরি কমিটিও একটি মূল্যায়ন করেছে। এসব নিয়েই বিইআরসির কার্যালয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

বেসরকারি খাতের হিসাবে, দেশে বর্তমানে বছরে ১০ লাখ টন এলপিজির চাহিদা রয়েছে। গ্রাহক প্রায় ৩৮ লাখ। বাজারের ৯৮ শতাংশ বেসরকারি খাতের দখলে। বর্তমানে ২৯টি কোম্পানি এলপি গ্যাসের ব্যবসা করে।

বাজারে এখন ১২ কেজির এক সিলিন্ডার এলপিজি বিক্রি হয় ৯৫০ থেকে ১ হাজার ৫০ টাকায়। এ দর বেশ হেরফের হয়। ছোট একটি পরিবারে মাসে অন্তত দেড় হাজার টাকার গ্যাস লাগে। যেসব বাসায় সরকারি সংস্থার পাইপলাইনের গ্যাস–সংযোগ রয়েছে, তাঁদের দুই চুলার মাসিক ব্যয় ৯৭৫ টাকা। যাঁদের মিটার আছে, তাঁদের খরচ হয় ৬০০ টাকার আশপাশে।

বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতি মাসে দাম নির্ধারণের চিন্তা। গ্রাহক সুবিধায় ভর্তুকির কথাও ভাবছে কমিশন। হাইকোর্টের নির্দেশে দাম নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে বিইআরসি। প্রস্তাব জমা দিয়েছে কোম্পানিগুলো। ২০১২ সালে খসড়া হলেও এখনো চূড়ান্ত হয়নি প্রবিধানমালা।

দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছে এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব)। সংগঠনটির সভাপতি আজম জে চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ভোক্তার জন্য একটা সহনীয় মূল্য দেওয়াটাই সবার উদ্দেশ্য। কিন্তু এত দিনেও দাম ঠিক করার জন্য একটা প্রবিধানমালা তৈরি হয়নি। তিনি বলেন, বোঝাপড়ার মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করা হলে সবার জন্য ভালো হবে।

বিইআরসি ও ক্যাব সূত্র বলছে, পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের খুচরা মূল্য নির্ধারণে একটি প্রবিধানমালার খসড়া তৈরি করে ২০১২ সালে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে পাঠায় বিইআরসি। এরপর জ্বালানি বিভাগ বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে তা কমিশনে ফেরত পাঠায়। তবে সেই খসড়া আজ পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি।

এলপিজির দাম নির্ধারণ নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর গত ২৩ ডিসেম্বর বিইআরসিকে একটি চিঠি দিয়ে জ্বালানি বিভাগ শুধু এলপি গ্যাস নিয়ে একটি প্রবিধানমালা তৈরি করতে বলেছে। এ বিষয়ে জ্বালানিসচিব মো. আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আট বছরেও প্রবিধানমালা তৈরি করতে না পারার দায়িত্ব পুরোপুরি বিইআরসির।

তবে দীর্ঘ কালক্ষেপণের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বিইআরসির সদস্য (পেট্রোলিয়াম) মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, সব বিষয় গণশুনানিতে আলোচনা হবে।

দাম কত হতে পারে
বিইআরসির কাছে এলপি গ্যাসের দাম নিয়ে যে প্রস্তাব বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়েছে, তাতে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ২৫৯ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। শুধু প্রমিতা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান একই পরিমাণ গ্যাসের দাম ১ হাজার ৪২ টাকা করার প্রস্তাব দেয়। অন্যদিকে সরকারি সংস্থা এলপি গ্যাস লিমিটেড (এলপিজিএল) তাদের গ্যাসের দাম সিলিন্ডারপ্রতি (১২ কেজি) ৭০০ টাকা করার কথা বলেছে।

এলপিজির দাম নির্ধারণ নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর গত ২৩ ডিসেম্বর বিইআরসিকে একটি চিঠি দিয়ে জ্বালানি বিভাগ শুধু এলপি গ্যাস নিয়ে একটি প্রবিধানমালা তৈরি করতে বলেছে। এ বিষয়ে জ্বালানিসচিব মো. আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আট বছরেও প্রবিধানমালা তৈরি করতে না পারার দায়িত্ব পুরোপুরি বিইআরসির।

সূত্র জানিয়েছে, এসব প্রস্তাব মূল্যায়ন করে বিইআরসির কারিগরি কমিটি বলছে, বেসরকারি খাতে ১২ কেজির দাম ৮৬৬ টাকা নির্ধারণ করা যেতে পারে। সরকারি কোম্পানিটির ক্ষেত্রে দাম হতে পারে ৯০২ টাকা।

এ বিষয়ে বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের হেড অব ডিভিশন (সেলস) জাকারিয়া জালাল প্রথম আলোকে বলেন, সিলিন্ডার তৈরির জন্য কোম্পানির দেওয়া ভর্তুকি, বিনিয়োগের সময় নেওয়া ঋণের সুদের হার বিবেচনা করা হয়নি। এ ছাড়া ডিসেম্বরের বিশ্ববাজার দর ধরে তারা হিসাব করেছে। বাকি কোনো কিছু পরিবর্তন না করে শুধু জানুয়ারির মূল্য হিসাব করলেই ১২ কেজির দাম ১ হাজার ৫০ টাকা হয়ে যাবে।

বর্তমানে দেশে এলপি গ্যাসের দাম নির্ভর করে সৌদি আরামকো নামে পরিচিত সৌদি অ্যারাবিয়ান অয়েল কোম্পানির নির্ধারিত দামের ওপর। এলপি গ্যাস তৈরির দুই উপাদান প্রপেন ও বিউটেনের দাম প্রতি মাসে নির্ধারণ করে সৌদি আরামকো। বিইআরসির কারিগরি কমিটি বলছে, আগের মাসের সৌদি সিপির ভিত্তিতে পরবর্তী মাসের জন্য ভোক্তাপর্যায়ে এলপি গ্যাসের মূল্য হার পরিবর্তন করা যেতে পারে।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে এলপি গ্যাস পৌঁছাতে হবে। বিইআরসি যদি দাম নির্ধারণে ব্যর্থ হয়, তাহলে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।