বাবা এক সংজ্ঞাহীন শব্দ

বাবা শব্দটি কারও কাছে বটবৃক্ষ। কারও কাছে মাথার ওপর বিশাল একটা ছাদের ন্যায় কিংবা তপ্ত রোদে এক টুকরো মেঘ। কারও কাছে বাবা মানে ঈদ, বাবা মানে পৃথিবী—কত কিছুর সঙ্গেই না আমরা এর তুলনা করতে যাই। আসলেই কি বাবার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয়! স্বাভাবিকভাবেই না। এগুলো নিছক কিছু শব্দমাত্র। বাবার তুলনা বাবা নিজেই। এ এক সংজ্ঞাহীন শব্দ। 

১৯০৯ সাল। সোনোরা স্মার্ট ডোড নামে এক আমেরিকান নারী বাবা দিবস প্রতিষ্ঠা এবং ওই দিন সরকারি ছুটি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হয়ে মাঠে নামেন। ডোডের বাবা, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ছয় সন্তানকে লালন–পালন করেন। ডোড চিন্তা করলেন, মায়েদের মতো বাবাদেরও সম্মান জানানো উচিত। তিনি এক বছর ধরে একটি পিটিশনে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১০ সালের ১৯ জুন ডোডের জন্মরাজ্য ওয়াশিংটনে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা দিবস উদ্‌যাপন করা হয়।

বাবা এক অনুপ্রেরণার গল্প, বাবা এক সাহসের গল্প। বাবার বিশালতা মাপার কোনো যন্ত্র কোনো দিন আবিষ্কৃত হবে না, তা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। সমুদ্রের বিশালতা দেখে আমরা বিমূর্ত হই কিন্তু বাবা মানুষটার বিশালতা যেন এক রহস্য। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় কিংবা অভিযোগ কোনো কিছুই তাঁকে দায়িত্ব থেকে পিছপা হতে দেয় না। নীরব জোগানদাতা।

প্রথম স্কুলে যাওয়া, সাইকেলের প্যাডেল চালানো থেকে সাঁতার শেখা সবকিছুতে বাবা নামের বন্ধুটির ভালোবাসা তখন বুঝতে না পারলেও স্মৃতিগুলো জ্বলজ্বল করে চোখের সামনেই। রক্তে–মাংসে গড়া মানুষটি দিন দিন সাধারণ থেকে হয়ে ওঠে অসাধারণ, অনুকরণীয় আদর্শ৷ স্থান–ভাষাভেদে বাবা ডাকটি বদলালেও, বদলায় না রক্তের টান। চিরশ্বাশত এক সম্পর্ক। 


‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতে/ বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না/ জানলার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা/ মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না/ আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়…।’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদারের গাওয়া এই গানই বলে দেয়, বাবা এক অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রতীক। 


বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’–এর সেই বাবার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত চলচ্চিত্রে খুঁজে পাওয়া যায় অসাধারণ এই বাবাকে। অভিনেতা রবার্তো বেনিনির তুলে ধরা চরিত্রটির নাম গুইডো। শিশুসন্তানের নাম যশোয়া। জার্মান সেনারা ট্রেনে করে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায় পিতা–পুত্রকে। অসহনীয় যন্ত্রণার জীবন। যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যু। কিন্তু ছেলেকে এই পরিস্থিতি এতটুকু বুঝতে দেননি বাবা।

ছেলেকে তিনি বলার চেষ্টা করেন, এটা একটা খেলা। যে দ্রুত বেশি পয়েন্ট পাবে তাকে সত্যিকারের একটি ট্যাঙ্ক উপহার দেওয়া হবে। বাবা ছেলেকে বলেন, সে যদি মায়ের কাছে যেতে চায়, খিদে পেলে খাওয়ার জন্য কান্না করে, আর ঘরে লক্ষ্মী ছেলের মতো লুকিয়ে না থাকে, তাহলে পয়েন্ট কাটা যাবে। এভাবে বাবা করুণ মৃত্যুর শিকার হলেও, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের আতঙ্ক থেকে সন্তানকে শতভাগ রক্ষা করেন।

সন্তান হিসেবে বাবার প্রতি আমাদেরও কিছু দায়িত্ব থাকে। আমরা কি পারি বাবার প্রতি আনুগত্য দেখাতে? আমরা কি পারি, তাঁর শেষ বয়সে লাঠি হতে? বাবা হওয়াটা যেন এখন এক অভিশাপে পরিণত হচ্ছে না তো! বাবারা বৃদ্ধ হলেই ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম। আমরা যে মানবতার কথা বলি, এই বৃদ্ধাশ্রমগুলো হলো মানবতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি, সমাজের বিষফোড়া। ছোঁয়াচে রোগের মতো এই বিষফোড়াগুলো ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। সারা জীবন বিনা পারিশ্রমিকে সন্তানদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া মানুষটির আজ কোনো গন্তব্য নেই, নেই কোনো আশ্রয়, নেই কোনো অভিযোগ। 

একদিন এক বাবা আর ছেলে পার্কে বেড়াতে গেল। বয়সের ভারে বাবা নতজানু, চোখে দেখে না ঠিকঠাক, অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠেন। ছেলে, সুঠাম, সুন্দর চেহারার অধিকারী। দুজন পাশাপাশি বসে আছে। হঠাৎ একটা পাখি এসে বসল তাদের সামনে। বাবা চেয়েছিলেন ছেলের চোখ দিয়ে দেখবে সবকিছু। ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, ওটা কী? ছেলে উত্তর দিল, বাবা ওটা পাখি। কিছুক্ষণ পর বাবা আবার জানতে চায়, ওটা কী? ছেলে এবার একটু রাগান্বিতভাবে বলল, পাখি। খানিকবাদে আবারও বাবা প্রশ্ন করে, ওটা কী? এবার ছেলে রাগ সামলাতে না পেরে বলল, কেন এত বিরক্ত করছ? চুপচাপ বসে থাকো। বাবা চুপ হয়ে রইল। একটা ডায়েরি নিয়ে এসে আবার ছেলের পাশে বসে পড়ল। ডায়েরিটা ছেলের হাতে দিয়ে বলল, এটা পড়ো। ছেলে পড়তে শুরু করল— 
১৯৭০ সাল, এক বিকেলবেলা। ছেলেকে নিয়ে পার্কে গিয়েছি। ছেলেটা একটা পাখি দেখে জানতে চাইল, বাবা এটা কী? আমি আনন্দের সঙ্গে উত্তর দিয়ে বলি, এটা পাখি। একবার নয়, দুবার নয় টানা ২৩ বার জানতে চেয়েছে, বাবা ওটা কী? প্রতিবারই আমার এত ভালো গেছে বলে বোঝাতে পারব না। ছেলেকে নতুন কিছু দেখাতে পেরে বিকেলটা আরও সুন্দর হয়েছে। এমন বিকেল বারবার আসুক। 
ডায়েরিটা পাশে সরিয়ে রাখল। ছেলে বাবার কাঁধে মাথা রেখে বসে রইল পুরো সময়টা। 
শতবর্ষী হোক পৃথিবীর সকল বাবা। 

* শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]