বাবাকে আর খুঁজবেন না ওহিদুর

ওহিদুর রহমান ওরফে বাবু
ওহিদুর রহমান ওরফে বাবু

প্রায় তিন বছর ধরে বাবা নিখোঁজ। বাবার খোঁজে পুলিশের বিভিন্ন দপ্তর ও গণমাধ্যম কার্যালয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। পাননি। তবে হাল ছাড়েননি। বাবাকে পাবেনই—এমন স্বপ্ন ও আশা নিয়ে প্রিয় মানুষটিকে খুঁজে ফিরছিলেন তিনি। হঠাৎ পেট্রলবোমার ছোবল তাঁর সে স্বপ্নসাধ গুঁড়িয়ে দিল। তিনি নিজেই হারিয়ে গেলেন না-ফেরার দেশে।
তিনি ঢাকা কলেজের ছাত্র ওহিদুর রহমান ওরফে বাবু (২০)। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শাহবাগে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হওয়া ১৯ জনের মধ্যে তিনিও একজন। পুরান ঢাকার আগামাসি লেনের বাসা থেকে বের হয়ে বাসযোগে শাহবাগে যাওয়ার পথে এই নারকীয় হামলার শিকার হন তিনি। আগুনে তাঁর শরীরের ২৮ শতাংশ পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় শ্বাসনালি। অবস্থার অবনতি হলে গত শনিবার তাঁকে আইসিইউতে রাখা হয়। গত সোমবার কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয় তাঁকে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে আজ বুধবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিবিড় পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
ওহিদুরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শাহবাগের ওই হামলার ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে তিনজনে। গত ২৬ অক্টোবর থেকে আজ বুধবার পর্যন্ত যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১০ জন। প্রতিটি মৃত্যুতে যেমন শোকের সাগরে ভাসছে পরিবার, তেমনি মারা যাওয়া অনেকে জীবিকার একমাত্র অবলম্বন বলে নিদারুণ বিপাকে পড়েছে এসব পরিবার। ওহিদুর ছিলেন পরিবারে কনিষ্ঠ সদস্য। নিখোঁজ বাবার খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় ঢুঁ মারতে মারতে পরিবারের জন্য হয়ে উঠেছিলেন অনেক বড় একজন।

আজ ভোর ছয়টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পা রাখতেই শোনা গেল হূদয়-চেরা কান্নার শব্দ। ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, শোকে পাথর মা সালেহা বেগমকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন স্বজনেরা। মৃত্যুশোকে স্তব্ধ মা মাঝেমধ্যে হাহাকার করে উঠছিলেন, ‘বাবু, তুমি আমারে ছেড়ে যাইতে পারলা!’

আদরের দেবরের শোকে বিলাপ করে চলেছেন ভাবি সানু আক্তার। ওহিদুরের লাশ দেখে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন ভগ্নিপতি মো. শোয়ায়েব। ঘটনার পর থেকে এ স্বজনেরা ওহিদুর সুস্থ হয়ে ওঠার আশায় কাটিয়েছেন নির্ঘুম রাত। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে একে একে হাসপাতালে ছুটে আসেন স্বজন, বন্ধু ও পরিচিতজনেরা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়েন বুকফাটা কান্নায়।

দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে ওহিদুর সবার ছোট। বাবা হাজি ওজিউল্লাহ গণপূর্ত অধিদপ্তরের জরিপকারক ছিলেন। বঙ্গবাজার এলাকার একটি বিপণিকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন ওজিউল্লাহ। ২০১১ সালে আগামাসি লেনের বাসা থেকে বের হওয়ার পর তিনি নিখোঁজ হন। তখন সবেমাত্র গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে আলিম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছেন ওহিদুর। বাবা নিখোঁজ হওয়ার দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে একই মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করে ভর্তি হন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। বাবার সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাঁপের কারণে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। পড়াশোনায় ছেদ পড়ায় এক বছর পর ঢাকা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন।

ফেসবুকেও বাবার বেশ কয়েকটি ছবি দিয়েছেন ওহিদুর। গত ১৬ অক্টোবর ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘বাবা ছাড়া আরেকটা ঈদ কাটালাম। যত আনন্দ করি না কেন, প্রতিটা কদমে বাবা না থাকার কষ্টটা অনুভব করলাম...আল্লাহ, তুমি বাবাকে সুখে রাখো।’

বাবাকে খুঁজতে গিয়ে ওহিদুরের সখ্য গড়ে ওঠে গণমাধ্যমের বেশ কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে। কোনো ঘটনা ঘটলেই ফোন করে তিনি জানাতেন। বৃহস্পতিবার ঘটনার পর ঢাকা মেডিকেলে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁর এমন পরিস্থিতি দেখে ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়েন অনেকে। আবেগে ভাসেন তাঁরাও। মারাত্মক দগ্ধ হওয়া ওহিদুর ঘটনার পর চোখ খুলতে পারেননি। মুখে দেওয়া ছিল অক্সিজেন। তবে তাঁর কাছে যাওয়া পরিচিত গণমাধ্যমকর্মীকে চিনতে পেরেছেন তিনি। স্বজনেরা ওই গণমাধ্যমকর্মীর নাম ধরে তাঁর কানে আস্তে আস্তে বলতেন ‘তুমি কি তাকে চেনো?’, ওহিদুর ওই গণমাধ্যমকর্মীর প্রতিষ্ঠানের নাম বলেছেন। আর বলেছেন, ‘ভাই, আমার জন্য দোয়া কইরেন।’

তবে গত কয়েক দিন আর কারও কাছ থেকে দোয়া চাইতে পারেননি ওহিদুর। কোনো কথাই বলতে পারেননি তিনি। শ্বাসযন্ত্র দেওয়ার আগে চিকিত্সকেরা শেষবারের মতো তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিয়েছিলেন। ওই সময়ও তেমন কথা বলতে পারেননি ওহিদুর।

তবে ওহিদুরের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা-দোয়া করেছেন অনেকে। অনেক গণমাধ্যমকর্মীও তাঁকে নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অনেকে সুস্থতা কামনা করেছেন। তাঁর ফেসবুক জুড়ে তাঁর বন্ধুরাও তাঁর জন্য প্রার্থনা করেছেন। তাঁর জন্য রক্ত খুঁজেছেন। এক বন্ধু লিখেছেন, ‘বাবু, তুই বলেছিলি বাইরে গেলে আমাকে অনেক কিছুই দিবি, আমাদের কিচ্ছুর দরকার নেই। তুই শুধু আমাদের মাঝে ফিরে আয়।’ তবে সব প্রার্থনা, সব চেষ্টা, সব শুভ কামনাকে ব্যর্থ করে দিয়ে সবার কাছ থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ওহিদুর।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে কোনো কারণে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ওহিদুর। তাঁর চিরযাত্রার সঙ্গে কেন জানি তা অনেকটাই মিলে যায়। তিনি লিখেছিলেন, ‘যামু যামু ভাবতেছি, কিন্তু সময়-সুযোগ হইতেছে না! যাক, আজকে দুটোই পেয়ে গেলাম।’