বাবার হাত ধরে কৃষিকাজে

২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পান নবদ্বীপ মল্লিক। তাঁর বাবা সুভাস মল্লিকও পেয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের পুরস্কারছবি: সাদ্দাম হোসেন

সুভাস মল্লিকের অভাবের সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছিল মুলাবীজ উৎপাদন করে। আশির দশকে ভারত থেকে মুলাবীজ আমদানি করা হতো। এর বিপরীতে সুভাস নিজের জমিতেই শুরু করেছিলেন ওই বীজ তৈরির কাজ। ওই বীজ কৃষকদের সরবরাহ করতেন। ব্যাপক চাহিদা থাকায় বিক্রিও হতো দেদার।

মুলাবীজ উৎপাদনে সফল হওয়ার পর বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদন শুরু করেন সুভাস মল্লিক। তখন ফুলকপিবীজও ভারত থেকে আনা হতো। তাই সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি ফুলকপিবীজ উৎপাদন করতে শুরু করেন সুভাস মল্লিক। সেখানেও সফলতা পান। ওই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানানো হয় সুভাস মল্লিককে। সেটি ছিল ১৯৯৭ সালের কথা।

সুভাস মল্লিকের বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায়। তিনি কখনো চাননি, তাঁর দুই ছেলে কৃষিকাজে যুক্ত হোক। পড়ালেখা করে ছেলেরা বড় চাকরি করবে, এমনই আশা ছিল তাঁর। বড় ছেলে প্রদীপ মল্লিক স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন বটে, তবে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাবার কাজকেই। তিনি বিভিন্ন ফলদ, বনজ ও ফুলগাছের চারা তৈরি করে বিক্রি করছেন।

আর ছোট ছেলে নবদ্বীপ মল্লিকের পড়াশোনা থেমে যায় এসএসসির পরই। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। ২০১২ সালের দিকে সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় বেকারজীবন। উপজেলা কৃষি কার্যালয়ে দিনব্যাপী এক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পান সুভাস মল্লিক। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সেখানে যেতে পারেননি তিনি। ওই প্রশিক্ষণে পাঠান ছোট ছেলে নবদ্বীপকে। চুইঝালের চারা উৎপাদনের ওই প্রশিক্ষণটি কেন যেন নবদ্বীপের মনে ধরে যায়। বাড়িতে এসে পরিকল্পনা করেন চুই চারা উৎপাদনের। পরিকল্পনা থেকেই বাবার সঙ্গে হাত লাগান মাটিতে। সেটি ২০১৪ সালের কথা। বাবা-ছেলের নতুন নতুন পরিকল্পনা আর সঠিক বাস্তবায়নে সফলতা ধরা দেয়। ২০১৫ সালে ১০ শতক জমিতে জৈব সার ব্যবহার করে একটানা ১১ বার লালশাক উৎপাদন করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। ওই লালশাক বিক্রি করেই প্রায় ৫০ হাজার টাকার মতো লাভ করেছিলেন তিনি। পেঁপেগাছের গুটি কলম করেও সফল হয়েছেন নবদ্বীপ।

অন্যদিকে কম্পোস্ট সার তৈরি, জৈব বালাইনাশক তৈরি, চুই চারা উৎপাদন শুরু করেন নবদ্বীপ। কম্পোস্ট সার ব্যবহার করে নিরাপদ সবজি উৎপাদন করে ব্যাপক সফলতা পান। এই সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পান নবদ্বীপ। এখনো বাবা-ছেলে একসঙ্গেই কৃষিকাজ করেন। তবে বিভিন্ন ধরনের সবজির বাজারজাতকরণ পদ্ধতি, বিদেশে রপ্তানি, দেশব্যাপী চুইঝালের বাজার তৈরি করায় বেশি সময় দেন নবদ্বীপ। সব খরচ বাদ দিয়ে বর্তমানে ২৫ লাখ টাকারও বেশি আয় করেন তিনি। ৩৩ বছর বয়সী ওই যুবক এখন স্বপ্ন দেখছেন নিরাপদ ফসল উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করার।

নবদ্বীপ বলেন, ‘সবকিছু সম্ভব হয়েছে বাবার হাত ধরেই। একসময় বাবাই চাইতেন না, ছেলে কৃষিকাজে যুক্ত হোক। আর এখন বেকারজীবনের অবসান ঘটেছে কৃষিকাজ দিয়েই। বাবার কৃষিকাজের রক্ত শরীরের সঙ্গে মিশে আছে বলেই হয়তো খুব সহজে কাজগুলো আয়ত্ত করতে পেরেছি।’

এখন নবদ্বীপ নিজের ও বর্গা নেওয়া মোট ছয় বিঘা জমিতে মৌসুমি সবজির আবাদ করেন। চার বিঘা জমিতে আছে কলা ও পেয়ারার বাগান। গরুর ১টি খামার আছে, সেখানে ১২টি গরু আছে, গড়ে ৩০ কেজি দুধ পান। করেছেন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, সেখান থেকে মেটে জ্বালানির চাহিদা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিনি নিজ হাতে বানানো ভার্মিপোস্ট বা জৈব সার ব্যবহার করেন।

চুইঝাল নার্সারি

খুলনা অঞ্চলের চুইঝাল বিখ্যাত। লতাজাতীয় এই গাছ এখন কিছু কিছু জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে। প্রায় চার বছর আগে চুই নার্সারি করেছেন নবদ্বীপ। সেখান থেকেও তাঁর ভালো আয় হয়।

নবদ্বীপ জানান, কয়েক বছর আগে তিনি একটি প্রশিক্ষণে গিয়ে চুইঝালের বাণিজ্যিক সম্ভাবনার বিষয়ে ধারণা পান। এরপর চুইয়ের চারা কিনতে গিয়ে দেখেন, অনেক দাম। তখন নিজেই কলমের মাধ্যমে চুইয়ের চারা উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এ সময় তাঁর মাথায় আসে চুই নার্সারি করার চিন্তা। এখন তাঁর চুই নার্সারি আছে। প্রতিবছর সেখান থেকেই ৮–১০ লাখ টাকা আয় করেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তাঁর চুই চারা নিতে আসেন মানুষ। কুরিয়ারের মাধ্যমেও বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করেন। সবাই এখন তাঁকে চুই নবদ্বীপ নামেই বেশি চেনেন।

আধুনিক কৃষক

৬৭ বছর বয়সী সুভাস মল্লিক এখনো পুরোদস্তুর কৃষক। প্রতিদিন কোদাল, কাঁচি নিয়ে খেতে যেতে না পারলে ভালো লাগে না তাঁর। বাবা-ছেলের পরিকল্পনাতেই আধুনিক কৃষি খামার এগিয়ে চলছে। নবদ্বীপ মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁর উৎপাদিত চারা ও পণ্য।

স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে ডুমুরিয়া অঞ্চলের জমিতে বছরে মাত্র দুবার ধান উৎপাদিত হতো। অন্য কোনো ফসল না হওয়ায় অভাব লেগেই থাকত কৃষকের ঘরে। তখন ধানেরও দাম ছিল অনেক কম। সব মিলিয়ে নিজেদের ৯ বিঘা জমির ধানই ছিল সম্বল। সংসারে অভাব থাকায় মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পেরেছেন সুভাস মল্লিক। কৃষিকাজ শিখেছেন তাঁর বাবা বিষ্ণুপদ মল্লিকের কাছ থেকে।

নবদ্বীপ ও তাঁর বাবা বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি ফুল, ফল ও বনজ গাছ, ত্বিন ও বারোমাসি শজনের চারা উৎপাদন করছেন।

ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছাদ্দেক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নবদ্বীপ মল্লিক একজন আধুনিক কৃষক। কৃষিকাজে মেধা খাটিয়ে নতুন কিছু করার পরিকল্পনা করছেন। সফলতাও আসছে তাঁর। এ ধরনের কৃষকদের কারণে দেশের কৃষি অনেক এগিয়ে যাবে।