বাবারা আসলে এমনই

প্রতিদিনের মতো মাঠের অনুশীলনে ঘাম ঝরিয়ে যাচ্ছে শুভ। কয়েক দিন হলো অনূর্ধ্ব-১৬ জেলা ক্রিকেট দলের জন্য ট্রায়াল দিয়ে এসেছে সে। ওখানে স্থানীয় প্রশিক্ষকদের ভালোই প্রশংসা কুড়িয়েছে এই ডান হাতি ওপেনিং ব্যাটসম্যান।

অনুশীলনে অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল নিয়ে কাজ করছে শুভ। বন্ধু সুহাসের করা একটি ফুল লেন্থের ডেলিভারি ড্রাইভ করার সঙ্গে সঙ্গেই পেছন থেকে ডাক পড়ল আরেক বন্ধু ইয়েনের, ‘শুভ তোর ফোন বাজছে।’

উইকেটে এমআরএফের ব্যাটটা রেখে দৌড় দিল শুভ। কল রিসিভ করল। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এল, ‘আমি কি শুভর সঙ্গে কথা বলছি?’
‘জ্বি, শুভ বলছি।’
তারপর মিনিট চারেক কথাবার্তা হলো। ফোনটা রাখার পর শুভর চেহারায় যেন এক সমুদ্র আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে। ইয়েন জানতে চাইল ব্যাপারটা কী?
‘দোস্ত আমি সিলেক্ট হইছি’, বলেই কিটব্যাগ গোছাতে শুরু করে দিল শুভ। আজ আর কোনো অনুশীলন নয়। তার আর তর সইছে না। বাড়ির পানে দিল এক দৌড়। শিগগিরই বাড়ির সবাইকে সুখবরটা জানাতে হবে যে!
দরজায় কড়া নাড়ছে শুভ। ওপাশ থেকে তা খুলে দিলেন বাবা। কাঁধে চাপা কিটব্যাগটা নামিয়ে রাজ্যের হাসিমুখ করে বাবাকে সুখরবটা দিল শুভ। খুব উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘বাবা আমি জেলা পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেট দলে সুযোগ পেয়েছি।’
কথাটা শুনে বাবা মনে হয় খুব বেশি খুশি হলেন না। চেহারায় কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা গেল না। চোখেমুখে তেমন কোনো আনন্দের ছাপও দৃশ্যমান হলো না। তৎক্ষণাৎ খানিকটা ভারী গলায় ছেলেকে বলে ওঠলেন, ‘ওসব খেলাধুলার ভূত মাথা থেকে সরাও। পড়ালেখাটা ঠিকমতো করো। খেলাধুলায় তোমার জীবন চলবে না।’ এই বলে নিজের কক্ষে চলে গেলেন তিনি।

বাবার কথায় মনটা খারাপ হয়ে গেল শুভর। কিটব্যাগটা কাঁধে তুলে বিষণ্ন মনে নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো সে। বাবা-মায়ের পরের ঘরেই থাকে শুভ। ওই কক্ষের দরজাটা অর্ধেক ভেড়ানো। তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাবার গলা শুনতে পেল শুভ। মাকে কী যেন বলছেন বাবা।
শুভ দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর বাবার কণ্ঠে শুনতে পেল, ‘আজ খুব খুশি খুশি লাগছে। আমার ছেলে সত্যিই ভালো খেলে। জেলা দলে সুযোগ পেয়েছে। আশা করি ও আরও বড় হবে। এখন থেকে ওর আলাদা করে যত্ন নাও। ভালো-মন্দ রান্না করে খাওয়াও। শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক রাখা চাই। বড় বড় ছক্কা মারতে হবে তো!’

কথাগুলো শুনে নিজের অজান্তেই দুচোখ গড়িয়ে জল পড়ছে শুভর। মুহূর্তেই শরীরের ভেতরে কী যেন একটা খেলা করে গেল। চোখে আনন্দাশ্রু আর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে নিজ কক্ষে প্রবেশ করল সে।
আসলে বাবারা এমনই। সন্তানের সঙ্গে শাসনের সুরে কথা বলে থাকেন ঠিকই, কিন্তু ভেতরে–ভেতরে তাঁরা খুবই নরম মনের মানুষ। পরিবারের সদস্যদের প্রতি তাঁদের অফুরান আবেগ আর নিখাদ ভালোবাসা থাকলেও সেগুলোর বহিঃপ্রকাশ হয়তো সেভাবে করতে পারেন না। তাঁরা পরিবারের প্রত্যেককে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেন। কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেন না। পরিবারের সবার মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য লড়ে যান জীবনের প্রতি সেকেন্ড। তবে কষ্টটা কাউকে বুঝতে দেন না।

বাবা হলেন বটবৃক্ষের মতো। শত বাধাবিপত্তির মধ্যেও পরিবারের সবাইকে আগলে রাখাই যাঁর কাজ। জীবদ্দশায় হুমায়ূন আহমেদ বলে গিয়েছিলেন, ‘পৃথিবীতে খারাপ মানুষ অনেক আছে, কিন্তু কোনো খারাপ বাবা নেই।’ যথার্থই বলেছিলেন।