বারনই নদীতে বাঁশের বেড়া

গল্পের জোয়ারেই যেন ভেসে যাচ্ছিল নৌকা। তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণের দুর্গাপূজার প্রবর্তন, তাঁর উত্তরসূরি লক্ষ্মী নারায়ণের প্রাসাদ ধ্বংস, বাংলার সুবাদার শাহ সুজার করুণ পরিণতি...। কিন্তু হঠাৎ ছেদ পড়ে। নৌকার সঙ্গে গল্পও যায় থেমে। সামনে বাঁশের বেড়া। যাঁরা বারনই নদীতে আড়াআড়ি এই বেড়া দিয়ে মাছ ধরছেন, তাঁরা অনড় অবস্থানে। আর যেতে দেবেন না।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় প্রবহমান নদীটির টুঁটি টিপে ধরা হয়েছে। মাছের অবাধ চলাচলে বাগড়া দেওয়া হচ্ছে।
নৌকাটিতে এই প্রতিবেদক ছাড়াও তখন ছিলেন নদী গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পাখি গবেষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। গত মঙ্গলবার সকালে শুরু হয়েছিল এই যাত্রা। উদ্দেশ্য চলনবিলে যাওয়া।
বারনই গভীর ও খরস্রোতা। রাজশাহী থেকে চলনবিল পর্যন্তই এর নাব্যতা রয়েছে। বারনই নদীর মূল উৎস আত্রাইবিল। সেখান থেকে শিবনদী নাম ধারণ করে রাজশাহীর তানোর উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পবা উপজেলার বাগধানী গ্রামে এসে বারনই নাম ধারণ করেছে। এরপর পড়েছে চলনবিলে। এই নদী সম্পর্কে ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ-ভারতের মুখ্য পরিসংখ্যান কর্মকর্তা উইলিয়াম উইলসন হান্টার তাঁর স্টাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল গ্রন্থে বলেন, রাজশাহীর যে কয়টি নদীর নাব্যতা আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে নাব্য হচ্ছে বারনই। এই নদীপথেই বাংলার সুবাদার ইসলাম খান ১৬০৮ সালে নওগাঁয় এসেছিলেন।
নদীটির বর্তমান অবস্থা দেখার উদ্দেশ্যে রাজশাহীর পরিবেশবাদী সংগঠন হেরিটেজের প্রতিষ্ঠাতা ও নদী গবেষক মাহাবুব সিদ্দিকী, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সহসভাপতি তারেক অণু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক সৌভিক রেজা, ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক উদয় শঙ্কর ও অনুপম হীরা মণ্ডল, তাহেরপুর কলেজের শিক্ষক নজরুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের ১৫ জন শিক্ষার্থী সকালে নৌকায় ওঠেন।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পবা এলাকা থেকে বারনই দিয়ে আর নৌকা যাওয়ার উপায় নেই। বাধ্য হয়ে বাগমারা উপজেলার মোহনগঞ্জ এলাকা থেকে নৌকায় উঠতে হলো। মোহনগঞ্জ থেকে বাগমারা উপজেলার একডালা পর্যন্ত পাঁচটি বাঁশের বেড়া পাওয়া যায়। বেড়ার মাঝখানে অল্প একটু জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে। সেখানে জাল পেতে মাছ ধরা হচ্ছে।
যেতে যেতে মাহাবুব সিদ্দিকী শিক্ষার্থীদের নদীর ধারের ইতিহাস বলছিলেন। এরপর হঠাৎ কামারখালী এলাকায় এসে ওই বাঁশের বেড়ার সামনে আটকে পড়া। এর আগে যে বেড়াগুলো সামনে পড়েছিল, সেখানে কেউ বাধা দেননি। তাঁদের বেড়াগুলো এত শক্তপোক্তও নয়।
পুঠিয়া উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। পরে তাঁর মধ্যস্থতায় নৌকা পার করা হয়। কিন্তু পুঠিয়ার সাধনপুর সেতুর নিচে এত কচুরিপানা জমেছিল যে এর ভেতর দিয়ে আর সামনে এগোনো সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে ফিরতে হলো।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কামারখালীতে বারনই নদীতে বাঁশের বেড়া দেওয়ার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাগমারা উপজেলার গোয়ালকান্দি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা আলমগীর হোসেনের লোকজন। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে আলমগীর হোসেন বলেন, আসলে বাগমারার তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদের ‘ছেলেরা’ এখানে বেড়া দিয়ে মাছ ধরেন।
অবশ্য এর আগেই মেয়রের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এলাকাটা তাঁর পৌরসভার মধ্যে নয়। এটা (বাঁশের বেড়া) তাঁর লোকজন করেননি।
যোগাযোগ করা হলে রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম রাব্বানি বলেন, মৎস্য সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কেউ প্রবহমান নদীতে আড়াআড়ি বেড়া দিতে পারেন না। তিনি ওই বেড়া অপসারণের ব্যবস্থা নেবেন।