বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে শুনতে হয়েছে কটুকথা

তানজিলা তাসনিম
। ছবি: প্রথম আলো

রাতে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। কনের বয়স ১৫, ছেলের বয়স ২১–এর কম। বাল্যবিবাহের এমন অন্যায় আয়োজনের কথা শুনে তা প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন ওই গ্রামের এক তরুণী। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দুই বছর ধরে তিনি নারীর অধিকার রক্ষা ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের পাঠ নিচ্ছেন। এ শিক্ষা যদি প্রয়োগ না করেন, তাহলে কী লাভ! ফোন দিলেন জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ। তরুণীর সেদিনের উদ্যোগে বাল্যবিবাহটি বন্ধ হয়েছিল। তবে এর জন্য তাঁকে ঝক্কিও কম পোহাতে হয়নি। শুধু ঝক্কি পোহানোর হতাশার মধ্যে গল্পটি শেষ হয়নি। শেষ পর্যন্ত ঘটনা যেখানে ঠেকেছে, তা অন্য নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা জোগাবে। গল্পটি একজন সাহসী তানজিলা তাসনিমের (১৯)।

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের ঘটনাটি ঘটে এ বছরের ২৭ আগস্ট। তানজিলা উপজেলার ৪ নম্বর হাড়িয়ারকুটি ইউনিয়নের মসজিদ পাড়া গ্রামের মেয়ে। তিনি বদরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। রুস্তম আলী ও আফরোজা বেগম দম্পতির দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে তানজিলা দ্বিতীয়।

আমরাই পারি জোট গত ২৭ নভেম্বর রাজধানীতে আয়োজিত এক সম্মেলনে নারীর অধিকার রক্ষায় অবদান রাখায় পাঁচজনকে ‘চেঞ্জমেকার পদক ২০২১’ দেয়। এর মধ্যে তানজিলাও একজন।

শুনতে হয়েছে কটূক্তি

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় নারীর অধিকার রক্ষার সচেতনতামূলক কাজে যুক্ত হন তানজিলা তাসনিম। যৌতুক, বাল্যবিবাহ, উত্ত্যক্ততা, পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে লোকজনকে সচেতন করতে বাড়ি বাড়ি যান। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের বাল্যবিবাহ ঠেকাতে ভূমিকা রাখতে বলেন। নিজের বড় ভাই গোলাম রাব্বানীর বিয়ের সময় বাবাকে বলেছিলেন, ‘বাবা যৌতুক কিন্তু নিবা না।’ বাবা তাঁর কথা রেখেছিলেন। ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক নেননি। তানজিলার ভাষায়, ‘নিজের ঘরে যৌতুক ঠেকাতে না পারলে অন্যরা আমার কথা শুনবে কেন?’ ২৭ আগস্টের বাল্যবিবাহ ঠেকানোর আগে আরও দুটো বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করেছিলেন তিনি।

২৭ আগস্টের বাল্যবিবাহটি ঠেকাতে গিয়ে কী ঘটেছিল, কেন তাঁর নাম প্রকাশ হলো, এরপর তিনি কী সমস্যায় পড়েছিলেন, সেসব প্রথম আলোর কাছে বর্ণনা করেছেন তানজিলা। তিনি বলেন, কনে–বর দুজনেরই বয়স কম ছিল। মেয়েটি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। বিয়ের রাতে অপর এক মেয়ের কাছে বিষয়টি জানতে পেরে তিনি ৯৯৯–এ ফোন দেন। সেখান থেকে তাঁকে তারাগঞ্জ থানায় যুক্ত করে দেওয়া হয়। দায়িত্বরত পুলিশ বৃষ্টির রাত বলে কিছুটা গড়িমসি করলেও শেষ পর্যন্ত বিয়েবাড়িতে পৌঁছায় এবং বিয়েটি বন্ধ হয়। তবে তিনি ৯৯৯–এ ফোন করে বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন তা প্রকাশ পেয়ে যায়।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯
‘ঘটনা যাচাই করার প্রয়োজনে থানা থেকে পরিচয় জেনে রাখা হয়। তবে তা গোপন রাখা বাধ্যতামূলক। থানা থেকে ফোন নম্বরটি প্রকাশ করে নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে।’
আনোয়ার সাত্তার, ৯৯৯–এর ফোকাল পারসন (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) পুলিশ পরিদর্শক

পরিচয় ফাঁস হয়েছে থানা থেকে

তানজিলা যে সংগঠনটির নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত, সেই ‘আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট (উই ক্যান)’ খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে তাঁর ফোন করার বিষয়টি ফাঁস হয়েছে থানা থেকে।

তানজিলা বলেন, বাল্যবিবাহটি প্রতিরোধের এক দিন পর গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাড়ি এসে বকাঝকা করে যান। সেটা শুনে বাবা খুব ক্ষুব্ধ হন। তিনি রেগে তানজিলাকে বলেন, ‘তোমাকে কি পড়াশোনা শিখিয়ে বড় করছি অন্যের বিয়ে ভাঙার জন্য। তুমি আমাদের মান–সম্মান নষ্ট করছ। ওদের বিয়ে হচ্ছে তো তোমার কী সমস্যা! তুমি আমার মেয়ে নও। যাও ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্ট করে খাও।’

বাবার এমন কথা শুনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তানজিলা। যে বাবা এত আদর দিয়ে বড় করছেন, তিনিও ভুল বুঝলেন! এরপর বাড়ির বাইরে গিয়ে পড়লেন আরেক বিপত্তিতে। রাস্তায় দিয়ে হেঁটে গেলে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা জটলা করে পেছন পেছন ছুটে বলত, ‘ওই যে যায় বিয়ে ভাঙতে!’ যেখানে যান সেখানেই বড়রা কটুকথা বলতেন। এসব অত্যাচার থেকে বাঁচতে নিজেকে ২০–২৫ দিন গৃহবন্দী করে রেখেছিলেন। যোগাযোগ করেন নিজ সংগঠনের আইনজীবী সুরাইয়া পারভীনের সঙ্গে। তিনি ৯৯৯–এ যোগাযোগ করে প্রতিকার চান।

৯৯৯–এর ফোকাল পারসন (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থানীয় পর্যায় থেকে ঘটনাটি ৯৯৯–কে জানানো হয়। এরপর আমি মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং তাঁকে কেউ হুমকি দিলে আইনি সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানাই। কোনো সমস্যা হলে যোগাযোগ করতে বলি। স্থানীয়ভাবে মেয়েটিকে কারা হয়রানি করেছে, সেটাও জানতে পারি।’ মেয়েটির পরিচয় গোপন রাখা হলো না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘটনা যাচাই করার প্রয়োজনে থানা থেকে পরিচয় জেনে রাখা হয়। তবে তা গোপন রাখা বাধ্যতামূলক। থানা থেকে ফোন নম্বরটি প্রকাশ করে নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে।’

ভয়কে জয় করেছেন তানজিলা

বিভিন্ন পর্যায় থেকে অনেকে পাশে দাঁড়ানোয় মানসিক শক্তি ফিরে পেয়েছেন তানজিলা। তিনি বলেন, ‘এখন মাথা উঁচু করে চলি। সামনাসামনি কেউ কটূক্তি করে না। এখন আমার মনে হয়, আমি নারীদের জন্য দেশের যেকোনো প্রান্তে গিয়ে কাজ করতে পারব।’

‘আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট (উই ক্যান)’ সংক্ষেপে আমরাই পারি জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক প্রথম আলোকে বলেন, ৪৮টি জেলায় ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘উই ক্যান’ নারী অধিকার বিষয়ে সচেতনতামূলক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। তানজিলা তাসনিম এই নেটওয়ার্কের একজন সদস্য। সে খুবই সক্রিয়। তার এলাকায় নারীর প্রতি যেকোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে সে প্রতিকার করতে এগিয়ে যায়। তানজিলার মতো কম বয়সী মেয়েগুলো যেন নারী নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে ঝুঁকিতে না পড়ে, সে জন্য সংস্থার আইনজীবী নেটওয়ার্ক আছে। তাঁর মতে, প্রতিটি গ্রামে তানজিলার মতো সচেতন মেয়েরা সক্রিয় হলে নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা কমে আসত।

নারীর অধিকার রক্ষায় অবদান রাখায় ‘চেঞ্জমেকার পদক ২০২১’ পেয়েছেন তানজিলা
ছবি: সংগৃহীত

‘আমার মেয়ে পুরস্কার পাইছে’

এবার আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ (২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর) পালন উপলক্ষে আমরাই পারি জোট গত ২৭ নভেম্বর রাজধানীতে আয়োজিত এক সম্মেলনে নারীর অধিকার রক্ষায় অবদান রাখায় পাঁচজনকে ‘চেঞ্জমেকার পদক ২০২১’ দেয়। এর মধ্যে তানজিলাও একজন।

তানজিলা জানান, পদক নিয়ে রংপুরে ফিরে গেলে বাবা বাসস্টেশন থেকে নিতে আসেন। মেয়েকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে থাকেন যে আশপাশের লোকজন কৌতূহল নিয়ে জানতে চায় কী হয়েছে! বাবা গর্ব নিয়ে বলেন, ‘আমার মেয়ে পুরস্কার পাইছে।’