বাল্যবিবাহ-বৈষম্য ঠেলে আমিনাদের এগোনোর গল্প
‘আমার পথচলা সহজ ছিল না। না পাওয়ার পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠি। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পরিবার থেকে আমার বিয়ে ঠিক করা হয়। আমি জানতাম, বাল্যবিবাহ অপরাধ। তাই নিজের চেষ্টায় সেই বিয়ে ঠেকাই। এখন আমি উচ্চমাধ্যমিকে পড়ি। বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করি।’
আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় রাজধানীতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিল আমিনা আক্তার। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অন্য মেয়েদের বাল্যবিবাহ না করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সচেতন হতে আহ্বান জানায় সে। বেসরকারি সংস্থা জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সে রাজধানীর গেন্ডারিয়া এলাকায় ২০টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করেছে। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে সে পেয়েছে ‘নির্ভয়া’ পুরস্কার।
একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বেসরকারি সংস্থা গুড নেইবারস বাংলাদেশের পক্ষে মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের কথা তুলে ধরে আরেক কিশোরী জেরিনা আক্তার।
দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় অর্থনৈতিক সংকটে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল মনোয়ারা আক্তারের। ওই সময় বেসরকারি সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশের বিনা মূল্যের উন্মুক্ত পাঠশালা ‘ওপেন স্ট্রিট স্কুল’–এ পড়ার সুযোগ পান। এখন তিনি ওই সংস্থার হয়ে শিক্ষকতা করছেন এবং একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় শিশু অধিকার রক্ষার প্রকল্পে কাজ করছেন।
জাতীয় কন্যাশিশু দিবস পালন উপলক্ষে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম আয়োজিত আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমিনা, জেরিনা, মনোয়ারার মতো লড়াকু কিশোরী-তরুণীরা নিজেদের কথা বলেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ছিল দিবসটি। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আমরা কন্যাশিশু—প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হব, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ব’।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি শিশুর মধ্যে অপরিমেয় সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উচিত সেই সম্ভাবনা বিকশিত করার সুযোগ সৃষ্টি করা। কন্যাশিশুদের প্রতি বিভেদ সৃষ্টি শুরু হয় পরিবার থেকে, যা পরে বিভিন্ন স্তরে বিস্তৃত হয়। করোনাকালে বাল্যবিবাহ বাড়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সচিব বলেন, ‘দেশে অসামান্য উন্নয়নে চ্যালেঞ্জ এখন বাল্যবিবাহ।’
একই কথা বলেন অনুষ্ঠানের আরেক বিশেষ অতিথি মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রাম চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, করোনাকালে অনেক জায়গায় বাল্যবিবাহ হয়েছে, এটা দুঃখজনক। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় এখন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের কাজে ব্যস্ত। বাল্যবিবাহের কারণে একটি শিশুর কোলে আরেকটি শিশু জন্ম নিলে দেশের জন্য প্রত্যাশিত প্রজন্ম তৈরি হয় না। প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ শিশুরাই ভবিষ্যৎকে শাসন করবে।
অনুষ্ঠানের অপর বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান লাকী ইনাম শিশুর অধিকার বিশেষ করে কন্যাশিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় অভিভাবকের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পরিবারে মেয়ে ও ছেলেশিশুর মধ্যে কোনো পক্ষপাতিত্ব থাকা উচিত নয়। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের সমাজ পুরুষনিয়ন্ত্রিত। গ্রামীণ সমাজে কন্যাশিশুকে এখনো বোঝা বলে মনে করা হয়।
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন একই সংস্থার সহ–সম্পাদক রাবেয়া বেগম।
অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করে দুই শিশু আয়শা সিদ্দিকা এবং মো. তামিম আহমেদ। পরে শিশুদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।