বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়

বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে (সোলার হোম সিস্টেম) বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ মানুষ বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করায় বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্টে (জিএসআর) বাংলাদেশ মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। আর মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ মানুষ বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ বা সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করে নেপাল এ তালিকায় প্রথম।

আজ মঙ্গলবার সকালে ২০২০ সালের বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে জিএসআর প্রকাশ করেছে আরইএনএ ২১। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম সোলার হোম সিস্টেমের জন্য বিশেষ ক্যাটাগরিতে স্থান পেয়েছে। বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে শীর্ষ ছয়টি দেশকে তালিকায় আনা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সেচের কাজেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশটির ১ হাজার ৫০০ সেচপাম্প সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে চালু রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

তবে বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারকারী বা উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ কোনো অবস্থানে নেই। ৪৭টি দেশের মধ্যে জনপ্রতি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে প্রথম হয়েছে আইসল্যান্ড। জাপান ছাড়া এশিয়ার কোনো দেশ এ তালিকায় স্থান পায়নি। তবে শীর্ষ বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন তালিকায় চীন ও ভারত স্থান পেয়েছে। আরইএনএ ২১ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানির (কয়লা) সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি (সৌর ও বায়ু) মূলধারার জ্বালানি হিসেবে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯–এর কারণে গত বছরের তুলনায় এ বছর ৮ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কম হবে। কিন্তু পৃথিবীকে বাঁচাতে প্রয়োজন কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা।

রিনিউবেল এনার্জি পলিসি নেটওয়ার্ক ফর দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি (আরইএনএ ২১) নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে সারা বিশ্বের অন্যতম প্রধান গবেষণা ও নীতি প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউএনইএফ, জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা ইউএনআইডিও, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক, এডিবি , গ্রিনপিসসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা আরইএনএ ২১ সদস্য। এ ছাড়া ১২টি দেশ এ সংস্থাটির সরাসরি সদস্য। এগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ভারত, সুইডেন, দক্ষিণ কোরিয়া অন্যতম।

বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ৪০–এর ওপর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পাবনায় সরকারি কোম্পানি নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, ফেনীতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বড় ধরনের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে। এভাবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আগামী দুই বছরের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। তিনি বলেন, সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ জীবাশ্ম জ্বালানির নিচে নেমে এসেছে, এটা সত্য। কিন্তু বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র করার কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জমির স্বল্পতা। সে কারণে সৌরবিদ্যুতের সঙ্গে কৃষি ও খামার কীভাবে করা যায়, তা ভাবা হচ্ছে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারের দিক থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসারের বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। এ কারণে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ ‘সোলার হোম সিস্টেম’ ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশে রয়েছে।

আজ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর পৃথিবীতে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গড়ে বেড়েছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশ এ হার বৃদ্ধিতে পৃথিবীতে অন্যতম। ২০১০ সালে বাংলাদেশে ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় ছিল, যা ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৯৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করছে। তবে দেশটি দুনিয়ার শীর্ষ ২০টি দেশের একটি, যারা রান্নার কাজে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসম্মত জ্বালানি ব্যবহার করে না। দেশটির ৮১ শতাংশ মানুষ রান্নার কাজে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জ্বালানি ব্যবহার করে। খারাপ মানের সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার বাংলাদেশে টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসার না হওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়।

আরইএনএ ২১ নির্বাহী পরিচালক রানা আদিব বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রবৃদ্ধি অনেক ভালো। কিন্তু সারা দুনিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদনের তুলনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনো উল্লেখযোগ্য নয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জনপ্রতি সর্বোচ্চ নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় ১ নম্বরে আইসল্যান্ড। দেশটিতে জনপ্রতি ২১৩৫ ইউনিট নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। এর পরের তালিকায় রয়েছে ডেনমার্ক, তারা ব্যবহার করে ১৬১৭ ইউনিট, তৃতীয় সুইডেন, তারা ব্যবহার করে ১৫০৪ ইউনিট, এরপর ৪ নম্বরে জার্মানি ১৪৪২ ইউনিট ও ৫ নম্বরে অস্ট্রেলিয়া ৮৭২ ইউনিট।
অন্যদিকে জলবিদ্যুৎ রয়েছে, এমন দেশের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ জনপ্রতি ব্যবহারে শীর্ষে রয়েছে আইসল্যান্ড। এরপর নরওয়ে, সুইডেন, কানাডা ও সুইজারল্যান্ডের নাম রয়েছে। জনপ্রতি ব্যবহারকারীর এ তালিকায় চীন ও ভারতের নাম নেই। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় ১ নম্বরে চীন, ২ নম্বরে যুক্তরাষ্ট্র, তৃতীয় স্থানে ব্রাজিল, চারে ভারত ও ৫ নম্বরে জার্মানি রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সারা দুনিয়ায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার বাড়ছে, সে তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। ২০৫০ সালের পর জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা হবে না অথচ বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে কয়লাকে প্রাধান্য দিয়ে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি শুধু পরিবেশের জন্যই ভালো এমনটি নয়, এটির ব্যয় কম, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে সরকারকে আরও আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এর আগে ৩ জুন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিনিউবেল এনার্জি এজেন্সির (আইআরইএনএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের চেয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতে খরচ কম। সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ গড়ে ৬ দশমিক ৮ সেন্ট। (প্রতি সেন্ট ৮৫ পয়সা ধরলে বাংলাদেশি টাকায় ৫ টাকা ৭৮ পয়সা হয়)। প্রতিবছরে এ উৎপাদন ব্যয় গড়ে ১৩ শতাংশ হারে কমছে। স্থল ও সাগর ভাগে স্থাপিত বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়ও প্রতিবছর কমছে। স্থলভাগে স্থাপিত বায়ুবিদ্যুতের ইউনিট-প্রতি উৎপাদন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৩ সেন্ট (৪ টাকা ৫০ পয়সা) ও সাগর ভাগে স্থাপিত কেন্দ্রের ব্যয় ইউনিট-প্রতি ১১ দশমিক ৫ সেন্ট (৯ টাকা ৭৭ পয়সা)। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে যেসব সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে, তার ব্যয় আরও কমে যাবে। সারা দুনিয়ায় আগামী বছর স্থাপিত সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ব্যয় হবে ৩ দশমিক ৯ সেন্ট (৩ টাকা ৩১ পয়সা), যা ২০১৯ সালের ব্যয় থেকে ৪৩ ভাগ কম।