‘বাসায় ফিরতে পেরেছি সেটাই অনেক’

চিকিৎসক দম্পতি অনীক চন্দ ও মনিকা চন্দ
ফাইল ছবি

‘চার মাস নয় দিন পর বাসায় ফিরছি। এখনো মাঝেমধ্যে অক্সিজেন লাগে। দাঁড়াতে পারি না ঠিকমতো। পুরোপুরি সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে। বাসায় ফিরতে পেরেছি সেটাই অনেক।’ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের চিকিৎসক অনীক চন্দ এভাবে মুঠোফোনে নিজের অভিব্যক্তি জানালেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে অনীক এত দিন নিজের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আজ বুধবার বাসায় ফেরেন।  ভর্তি হয়েছিলেন ১৩ জুন। তাঁর স্ত্রী মনিকা চন্দও পরে আক্রান্ত হন। সুস্থ হন স্বামীর আগেই। কিন্তু স্বামীর সংকটাপন্ন অবস্থার কারণে হাসপাতাল ছাড়েননি।

অনীককে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি করতে হয়েছে বলাই যায়। দু বার মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থা থেকে ফিরেছেন। স্বামীসেবা আর দুশ্চিন্তাই রাতগুলো নির্ঘুম কেটেছে মনিকার। সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে আপাতত বাসায় ফিরতে পারাটা আসন্ন শারদ উৎসবের আনন্দের চেয়েও বেশি তাঁদের কাছে।

করোনার প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর অনীক নিয়মিত কোভিড ওয়ার্ডে চিকিৎসা দিয়েছেন। অনীকের এজমা রয়েছে আগে থেকেই। তবু সেবা দিতে পিছপা হননি। চিকিৎসক সহকর্মীসহ অনেকের মৃত্যু কাছ থেকে দেখেছেন। একসময় নিজেও আক্রান্ত হন।

তাঁর আগে আরও ঝড় বয়ে যায় অনীক ও পরিবারটির ওপর। মার্চের প্রথম সপ্তাহে মারা যান তাঁর বাবা অরুণ চন্দ। ১ জুন বাবার পথ ধরেন মা জয়শ্রী চন্দ। দুজনেই নানা রোগে ভুগছিলেন। মায়ের মৃত্যুর তিন দিনের মধ্যে হাসপাতালের ফ্লু কর্নারে সেবা দিতে চলে যান অনীক। জ্বরাক্রান্ত হওয়ার কারণে ১১ জুন মায়ের শ্রাদ্ধও করতে পারেননি।

পরে হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে শুনেছেন করোনা আক্রান্ত সহকর্মী সহযোগী অধ্যাপক সমিরুল ইসলামসহ অনেকের মৃত্যু সংবাদ। কখনো খারাপ কখনো ভালো এভাবে কেটে যায়।

চিকিৎসক দম্পতির সঙ্গে হাসপাতালের চিকিৎসক ও অন্যরা।
সংগৃহীত

সাধারণ শয্যা থেকে আইসিইউ। আইসিইউতে থেকে পরে স্বামীকে নিয়ে মনিকা ওঠেন চমেক হাসপাতালের একটি কেবিনে। ওই ছোট্ট ঘরে গড়ে ওঠে তাদের ঘর সংসার।

ছোট দুই ছেলে পাপাই আর টিনটিন এবং ভাইঝি টুপাই এসে হাসপাতাল থেকে মাঝেমধ্যে আর ফিরত না। ২৫ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে টিনটিনের জন্মদিনের কেক কাটা হয়। অনীক বিছানায় শুয়ে বসে অক্সিজেনের নল মুখে ছবি তুলতেন।

এভাবে কেটেছে হাসপাতালের সময়। বারবার ইনফেকশানও হয়েছে তাঁর। নতুন করে ইনফেকশানের আশঙ্কায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা আর তাঁকে হাসপাতালে রাখতে রাজি নন। বাসায়ও দর্শনার্থী যাওয়ায় চিকিৎসকদের নিষেধ রয়েছে।

অনীকই এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালের সবচেয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেওয়া করোনা রোগী। তাইতো আজ দুপুরে অনীককে বিদায় জানতে কেবিনে ভিড় করেন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির, অনীকের চিকিৎসক অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষসহ সহকর্মীরা।

হুইল চেয়ারে বসে অনীক হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসেন। সহকর্মীরা হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতায় চোখ ছলছল করে ওঠে অনীক-মনিকার।

সহকর্মীদের প্রাণপণ চেষ্টা না থাকলে যে এই জীবন আর দেখাই হয়তো হতো না।

করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে আপাতত অনীক জিতেছে। সহকর্মীদের বিশ্বাস চূড়ান্ত বিজয়ীর বেশে অনীক আবার মানুষের সেবায় ফিরবেন হাসিমুখে।