বাহারি রঙের হরতনি

হরতনি প্রজাপতির ডানার নিচের দিক l ছবি: লেখক
হরতনি প্রজাপতির ডানার নিচের দিক l ছবি: লেখক

ওকে প্রথম দেখি ১৯ ডিসেম্বর ২০১০-এ আমার কর্মস্থল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি) ক্যাম্পাসে; একটি কলাপাতার ওপর। সেদিন ওর নয়নকাড়া রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এরপর আবার দেখা প্রায় দুই বছর পর। ২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সাদামতো কিছু একটা দেখে পাশের দেবদারুগাছটির দিকে তাকালাম।
দেখি, বিধবার মতো সাদা শাড়ি পরে ও বসে আছে। আমি ক্যামেরায় ক্লিক করতে করতে ওর একেবারে কাছে চলে এলাম। ও একটুও নড়ল না। শেষমেশ দেবদারুর পাতা ধরে টান দিতেই ও যেন অনিচ্ছায় উড়ে গেল। সাদার নিচে লুকিয়ে থাকা ওর লাল-হলুদ-কালো বাহারি রঙের দেখা পেলাম তখন। তবে ও বেশ দুর্বল ছিল, তাই বেশি দূর যেতে পারল না, মাটিতে কাত হয়ে পড়ে গেল। পরম মমতায় ওকে হাতে তুলে নিলাম, ও প্রতিবাদ করল না। বেশ মায়া হলো; বুঝলাম, ওর অন্তিম সময় চলে এসেছে। এটাই নিয়তি। মন খারাপ করে আমার কক্ষে চলে এলাম।
এতক্ষণ যার কথা বললাম, সে আমাদের অনিন্দ্য সুন্দর বাহারি প্রজাপতি ‘কমন যেজেবেল’ (Common Jezebel)। অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরী ও মনোয়ার হোসেনের ফিল্ড গাইড অনুযায়ী ওর বাংলা নাম ‘হরতনি’। Pieridae পরিবারভুক্ত এই প্রজাপতির বৈজ্ঞানিক নাম Delias eucharis।

হরতনি প্রজাপতির ডানার ওপরের দিক
হরতনি প্রজাপতির ডানার ওপরের দিক

হরতনি মাঝারি আকারের সুন্দর প্রজাপতি। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে প্রসারিত অবস্থায় ডানার মাপ ৬৩-৮৩ মিলিমিটার। সুন্দর এই প্রজাপতিটির রঙের বাহার কিন্তু এর ডানার নিচের দিকে। ডানাসহ দেহের ওপরের দিকের রং মূলত সাদা। সামনের ডানার গোড়ার দিকের কোষগুলো সাদা হলেও ওপরের প্রান্তের কোষগুলো হলদে। আর ডানার শিরাগুলো প্রশস্ত ও কালো। পেছনের ডানার গোড়ার দিকের কোষগুলো উজ্জ্বল হলুদ; আর কিনারার কোষগুলো দেখলে মনে হবে, বিধাতা যেন সেখানে একসারি পঞ্চভুজ আকারের কমলা-লাল ইট সাজিয়ে রেখেছেন। পেছনের ডানার শিরাগুলোর রংও কালো। স্ত্রী হরতনির সামনের ডানার শিরাগুলো পুরুষের থেকেও প্রশস্ত। তাই স্ত্রীটিকে বেশি সুন্দর দেখায়।
হরতনি বন্যাপ্রবণ এলাকার বাসিন্দা হলেও সবখানেই বাস করতে পারে। তবে ঘন বন ও ঘাসবনে কম দেখা যায়। আমাদের ক্যাম্পাস ছাড়াও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ওর দেখা পেয়েছি। শহর-বন্দর-গ্রাম যেখানেই ওদের খাদ্য সরবরাহকারী গাছ আছে, সেখানেই ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াতে দেখা যায়। ওরা বেশ ধীরগতিতে ওড়ে।
স্ত্রী হরতনি উপযুক্ত গাছের প্রতি পাতায় ১০-২০টি করে উপবৃত্তাকার আকারে ডিম পাড়ে। উজ্জ্বল হলুদ ও চকচকে ডিমগুলো পাতার নিচের দিকে সমান্তরালে সাজানো থাকে। ডিম ফুটে যে শূককীট বের হয়, বেঁচে থাকার জন্য তারা পাতা খেয়ে গাছের ক্ষতি করে। অন্যদিকে বড়গুলো কিন্তু ফুলের পরাগায়নে বেশ সাহায্য করে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মিয়ানমারে এদের দেখা যায়।