বাড়তি বিল করার নির্দেশ দিয়ে আইন ভেঙেছেন কর্মকর্তারা

এম শামসুল আলম
এম শামসুল আলম

গ্রাহকের কাছ থেকে বিদ্যুতের মূল্য বাবদ কত টাকা কোন খাতে এবং কীভাবে নিতে হবে, তা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) উন্মুক্ত গণশুনানির মাধ্যমে ঠিক করে দেয়। এর বাইরে গ্রাহকের কাছ থেকে বাড়তি এক টাকাও নেওয়া বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিভিন্ন সময় ভোক্তারা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের কাছ থেকে বিদ্যুতের বিল বেশি নেওয়া হচ্ছে। আর এবার এই অভিযোগ এত ব্যাপক আকারে এসেছে যে তা পাশ কাটানো সহজ ছিল না।

আগে গ্রাহকের বিদ্যুতের বিল হয়তো অর্থবছরের শেষ তিন–চার মাসে দুই শ থেকে তিন শ টাকা বেশি আসত। কিন্তু এবার বিদ্যুতের বিল এত বেশি এসেছে যে তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রাহকের বিদ্যুতের বিল ১০ গুণ বেশি এসেছে।

করোনার কারণে মিটার রিডাররা গ্রাহকের বাড়িতে যেতে পারেননি। যে কারণে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তিন মাসের বিদ্যুতের বিলের গড় হিসাব করে এ বছরের ওই তিন মাসের বিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। কিন্তু কাজটি না করে তারা বেআইনিভাবে বাড়তি বিল করার নির্দেশ দেয়। এমনকি কোন এলাকায় কত শতাংশ বাড়তি বিল হবে, সেটিও ঠিক করে দেয়। এভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণের পকেট থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার নজির নেই। এটি শুধু বেআইনি নয়, ভয়াবহ অন্যায়ও।

আমরা জানতে পেরেছি, সর্বোচ্চ ৬১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি বিল নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন ডিপিডিসির কর্মকর্তারা। বেআইনি এই নির্দেশের মাধ্যমে জনগণের পকেট থেকে শত শত কোটি টাকা লুট করে নেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোর এই দস্যুবৃত্তি থেকে জনগণকে রক্ষা করার কথা ছিল বিইআরসির। ভুতুড়ে বিল যাঁরা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে ডিপিডিসিসহ অন্য বিতরণ কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য নিয়ন্ত্রণকারী এই সংস্থা। এখন পর্যন্ত ডিপিডিসির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) কেউই এই চিঠির জবাব দেননি। বিইআরসি আইন অনুযায়ী, অভিযোগের জবাব না দেওয়ার শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড।

অভিযুক্তদের সাজার মুখোমুখি করতে বিইআরসি কেন ব্যর্থ হলো বা তারা কেন কঠোর হলো না—এটি বুঝতে গেলে বুঝতে হবে বিইআরসির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ কীভাবে হয় তা দিয়ে। বিইআরসির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগের নাম প্রস্তাব করা হয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে। সে অর্থে কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগে সচিবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। আর সচিব নিজেই ডিপিডিসির চেয়ারম্যান। যে কারণে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি বিইআরসি।

একদিকে যেমন ভুতুড়ে বিলের মাধ্যমে গণলুণ্ঠন হয়েছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রের আইন ভেঙেছেন প্রজাতন্ত্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা। ফলে তাঁরা ওই পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন।

 বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর ওপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ রাখে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ। বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বিদ্যুৎ–সচিব। একদিকে নিয়োগে ভূমিকা রাখা আবার সেই কোম্পানির চেয়ারম্যান হওয়ায় বিদ্যুৎ–সচিব স্বার্থসংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন। ভুতুড়ে বিলের নামে মানুষের পকেট থেকে শত শত কোটি টাকা লুট করে নেওয়া হলেও কোনো একটা বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি ঠিক এ কারণে।

দেশের চারটি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির চেয়ারম্যানই বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা। এটি অশনিসংকেত। এসব কোম্পানি গঠন করা হয়েছিল যাতে এগুলো বাণিজ্যিক কোম্পানি হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু বাণিজ্যিক কোম্পানির শীর্ষ পদে ও বোর্ডে বসানো হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের। তাঁরা জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থ না দেখে কতিপয় মানুষের স্বার্থ দেখছেন। শিগগিরই কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান পদ থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিতে হবে। আর মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা হওয়া উচিত নজরদারির। সেই কাজটি হচ্ছে না স্বার্থের সংঘাতের কারণে।

এখন সরকারের উচিত, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল—এই তিন মাসের বিদ্যুতের বিল বাতিল করা। এই তিন মাসের প্রকৃত বিল কত, সেটি বের করার সুযোগ রয়েছে। এরপর প্রকৃত বিদ্যুৎ বিল আগামী কয়েক মাসে সমন্বয় করা যেতে পারে।

এম শামসুল আলম: বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা