বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতিতে আস্থা শেষ হয়ে যায়নি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকে বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে দেখছে।

দেশের চিকিৎসার আয়োজন ও আলোচনা চলে মূলত অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে। হাসপাতালসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ, জনবল তৈরি, চিকিৎসা প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও আমদানি হয়েছে মূলত অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসাব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করার জন্য। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর দেখা যাচ্ছে, বিপুলসংখ্যক মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদি ও ইউনানি চিকিৎসকদের কাছ থেকে। অনেক মানুষের আস্থা আছে অ্যালোপ্যাথির বিকল্প ও লোকজ চিকিৎসাব্যবস্থায়। তাতে সরকারেরও সায় আছে।

সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গত নভেম্বরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নেয় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে। এর মধ্যে ২২ দশমিক ৫১ শতাংশ মানুষ চিকিৎসার জন্য যায় ‘হাতুড়ে’ বা ‘অযোগ্য’ চিকিৎসকদের কাছে। সরকারি ওই পরিসংখ্যানে আরও বলা হচ্ছে, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জেলা ও সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ মানুষ সেবা নেয়। অর্থাৎ সরকারের সব প্রতিষ্ঠান সম্মিলতভাবে যত মানুষকে সেবা দেয়, তার চেয়ে প্রতিবছর অনেক বেশি মানুষ সেবা পায় ‘হাতুড়ে’ বা ‘অযোগ্য’ চিকিৎসকদের কাছ থেকে। এর অন্যতম কারণ কিছু মানুষের বিশ্বাস আছে হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি চিকিৎসায়। কিছু মানুষের আস্থা লোকজ চিকিৎসাপদ্ধতিতে।

বিকল্প চিকিৎসাসেবা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাকে বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে দেখছে। অধিদপ্তরে অলটারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার বা বিকল্প চিকিৎসাসেবা কর্মসূচি ও পৃথক কার্যালয় রয়েছে।

এই বিকল্প চিকিৎসার প্রসার এবং এসব ক্ষেত্রে জনবল তৈরির কাজে সরকারকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ঢাকা শহরের মিরপুর এলাকায় সরকারি ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ডিগ্রি কলেজ এবং হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। শিক্ষার্থীদের পাঁচ বছরের কোর্স করতে হয়। পেশাচর্চা শুরুর আগে এক বছরের ইন্টার্নশিপ করতে হয়। বেসরকারি খাতেও সারা দেশে ২০টির বেশি কলেজ আছে।

বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ভারতীয় নিজস্ব চিকিৎসাপদ্ধতি আয়ুর্বেদিক (প্রাণবিজ্ঞান) চিকিৎসা বলে পরিচিত। ভাঙা বা স্থানচ্যুত অস্থিসন্ধির চিকিৎসা এবং টিউমার (অর্বুদ), হার্নিয়া, চোখের ছানি অপসারণে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকেরা দক্ষ ছিলেন। দেশে বর্তমানে ১৭২টি আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আছে। সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ৭০ জনের বেশি মেডিকেল কর্মকর্তা আছেন।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে এখনো অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা পুরোপুরি পৌঁছায়নি। কিন্তু তাদের ঘরের কাছেই আছে প্রাচীনতম চিকিৎসাসেবা হোমিওপ্যাথি, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক।
ডা. দিলীপ রায়, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোর্ড

পাঠান ও মুঘল সম্রাটদের আনুকূল্যে ভারতবর্ষে ইউনানি চিকিৎসা বিকশিত হতে থাকে এবং একপর্যায়ে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার স্থান করে নেয় ইউনানি। ইউনানি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দেশে ২৬৯টি। সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৭৫ জন ইউনানি চিকিৎসক কর্মরত আছেন।

১৮১০ থেকে ১৮৩৯ সালের মধ্যে জার্মান চিকিৎসক স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা সারা ভারতে গ্রহণযোগ্যতা পায়। দেশে প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান হোমিওপ্যাথি ওষুধ তৈরি করে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৯০ জন হোমিওপ্যাথির ডিগ্রিধারী চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন।

সরকারি হাসপাতালে আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকেরা মূলত বহির্বিভাগে চিকিৎসা দেন। বিকল্প চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনো হাসপাতালে শয্যা নেই। তবে সারা দেশে শহরে ও বাজারে আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার চেম্বার চোখে পড়ে। এমন চেম্বার ৩০ হাজারের বেশি হবে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।

লোকজ চিকিৎসা

বিশ্বাস, লোকাচার, সংস্কৃতি এসবের ওপর ভিত্তি করে লোকজ চিকিৎসাব্যবস্থা মানুষের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। এই চিকিৎসার সুনির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি নেই। বয়স্ক লোক, ধর্মীয় নেতা বা যেকোনো সাধারণ মানুষ এই চিকিৎসা দিতে পারেন। বাংলাদেশের গ্রামে ও শহরে এই চিকিৎসা আছে।

উদ্ভিদের শিকড়, বাকল, ফল, ফুল, পাতা, বীজে রাসায়নিক আছে। উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ সেদ্ধ করে বা বেটে বা পিষে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে।

দেশে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে লোকজ চিকিৎসা নজরে পড়ে। এ চিকিৎসাপদ্ধতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উদ্ভিদের ব্যবহার কী আছে, তা অনুসন্ধান করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম। প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় বৈদ্যদের ২ হাজার ২৯৫টি ব্যবস্থাপত্র পর্যালোচনা করে ৭০০টি উদ্ভিদের ব্যবহার দেখতে পেয়েছে।

উদ্ভিদের গুণাগুণ বর্ণনা করে কোন উদ্ভিদ কোন রোগ নিরাময়ে কাজে লাগে, তা নিয়ে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের তত্ত্বাবধানে ৬৪ জেলায় ৪৬৭টি ভেষজ উদ্ভিদ বাগান আছে। এসব বাগানের উদ্ভিদ মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোর্ডের চেয়ারম্যান দিলীপ রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে এখনো অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা পুরোপুরি পৌঁছায়নি। কিন্তু তাদের ঘরের কাছেই আছে প্রাচীনতম চিকিৎসাসেবা হোমিওপ্যাথি, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক। এসব চিকিৎসায় মমতা আছে, অথচ পার্শপ্রতিক্রিয়া কম। তাতেই মানুষের আস্থা।’