বিকির ‘কর্মে’ কাজের খোঁজ

বিকি রাসেল
ছবি: সংগৃহীত

গাড়িচালক, বাবুর্চি অথবা অনলাইন পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকারী—এসব চাকরি এখন অ্যাপেই খুঁজে পাওয়া যায়। মুঠোফোনে তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি গুগলের ‘কর্ম’ নামের অ্যাপটি ডাউনলোড করে নিলেই হলো। একটু ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি।

কর্ম অ্যাপটি গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ডাউনলোড করা হয়েছে ৫০ লাখের বেশি বার। সর্বশেষ এক বছরে এতে এক লাখ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন নিয়োগদাতারা। একটি বিশেষ দিক হলো গুগলের এই অ্যাপ তৈরির মূল উদ্যোক্তা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তরুণ বিকি রাসেল। ৩৮ বছর বয়সী বিকি বাংলাদেশের স্বনামধন্য ডিজাইনার বিবি রাসেলের ছেলে। বিকির নেতৃত্বে তৈরি অ্যাপটি ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ দিয়ে যাত্রা শুরু করে। এখন অবশ্য ইন্দোনেশিয়া ও ভারতেও চালু হয়েছে।

কাজ খুঁজে পাওয়ার জন্য দেশে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইট রয়েছে। বৈশ্বিকভাবে পেশাদারদের যোগাযোগ সাইটও রয়েছে। এর মধ্যে কর্ম অ্যাপের বিশেষত্ব হলো এটি মূলত স্মার্টফোনের নতুন ব্যবহারকারীদের কথা মাথায় রেখে ‘কর্ম’ কাজ করে। এতে ‘এন্ট্রি লেভেল জব’ বা পেশাজীবনের শুরুর দিকের চাকরি খুঁজে পাওয়া সহজ।

যা-ই হোক, বিকি রাসেলের কথায় আসা যাক। গুগলে বিকির কাজ মূলত বিজনেস অ্যান্ড অপারেশনস লিড হিসেবে। এখন তিনি কর্ম অ্যাপের পরিচালন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। থাকেন সিঙ্গাপুরে। জন্ম লন্ডনে। কৈশোর কেটেছে ঢাকায়। বয়স যখন ১১ ছুঁই ছুঁই, তখন দেশে ফিরে আসেন। ভর্তি হন স্কলাস্টিকা স্কুলে। ইংরেজি মাধ্যমে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল শেষ করেন সেখান থেকেই।

বিকির সঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হয়। কর্ম অ্যাপ, গুগল, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনসহ নানা বিষয় তিনি জানিয়েছেন।

গুগল উদ্ভাবনে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়, কর্মীদের সব সময় নতুন ধারণা নিয়ে ভাবতে বলে। প্রয়োজনে কর্মঘণ্টার ২০ শতাংশ আলাদা করে নতুন কোনো পরীক্ষামূলক উদ্যোগে ব্যয় করতে বলা হয়। সে উদ্যোগ সম্ভাবনাময় হলে অন্যান্য প্রকল্পের কর্মীদের এককাট্টা করে দল গঠন করে দেয় গুগল, অর্থ জোগান দেওয়া হয়; নতুন উদ্যোগ বা স্টার্টআপে যেমনটা হয়। গুগলে বিভাগটির নাম হয়ে গেছে ‘এরিয়া ১২০’। ‘কর্ম’ জন্ম নেয় গুগলের এরিয়া ১২০-এর এক উদ্যোগ থেকে।


বিকি রাসেল বলেন, ‘আমরা দেখলাম, বাংলাদেশে কাজ খোঁজা ও পাওয়ার সহজ এবং ভালো একটা মাধ্যম দরকার। সেটা ভবন নির্মাণশ্রমিকের বেলায় যেমন সত্য, করপোরেট চাকরির বেলায়ও প্রযোজ্য।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার দেশ। অর্থনীতিতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আর ইন্টারনেটে যুক্ত হওয়ার জন্য দেশের সিংহভাগ মানুষ ব্যবহার করেন মুঠোফোন। এর সঙ্গে নিজ দেশের সমস্যা সমাধানের প্রবল ইচ্ছাটাও কাজ করেছে। এই সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে কর্ম অ্যাপ চালুর উদ্যোগ নিই।’

বিকি রাসেল জানান, শুরুতে কর্ম অ্যাপ ছিল চার সদস্যের একটি দল। এখন অনেক বড়। গুগলের অন্যান্য দলের কর্মীরাও কর্মের সঙ্গে যুক্ত। প্রকৌশল, পণ্য উন্নয়ন এবং নকশা দলের সদস্যরা এশিয়া ও আমেরিকায় থাকেন। আর ব্যবসা ও পরিচালনের (অপারেশনস) দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীরা ভারত ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় থাকেন। প্রতিটি দেশে চুক্তি ভিত্তিতে তৃতীয় পক্ষের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গেও কাজ করে কর্ম।

বিকির প্রথম চাকরি অবশ্য গুগলে ছিল না। ২০০১ সালের দিকে লন্ডনের কিংস কলেজে পড়ার সময় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে পণ্য বিক্রি করেছেন। টি-শার্ট বিক্রি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষে যোগ দেন বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিলওয়ার্ড ব্রাউনে, পদ ছিল গবেষক। এরপর ইলেকট্রনিক ডেটা সিস্টেমস (ইডিএস) নামের একটি প্রতিষ্ঠানে বিজনেস অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন।

কর্ম গুগলের ‘নেক্সট বিলিয়ন ইউজার্স’ (ভবিষ্যৎ শতকোটি ব্যবহারকারী) উদ্যোগের অংশ হিসেবে তৈরি। প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, এমন মানুষের জন্য এ উদ্যোগের আওতায় বিভিন্ন সেবা তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। গুগল প্লে স্টোরে কর্ম অ্যাপের পরিচিতিতে বলা হয়েছে, অ্যাপটি ডাউনলোড করলে চাকরিপ্রার্থীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজের খোঁজ দেওয়া হয়। খুচরা বিক্রি, সরবরাহ সেবা, রেস্তোরাঁ ও পর্যটনের মতো বিভিন্ন খাতে চাকরির বিজ্ঞপ্তিগুলো দেখা যায় কর্ম অ্যাপের মাধ্যমে।

বিকি রাসেল বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো নির্ভরতা ও কার্যকর উপায়ে কর্মদাতা ও প্রার্থীর মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া। আর তা করার জন্য আমাদের যতটা সম্ভব স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। কর্ম অ্যাপে সরাসরি যে কাজের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, সেখানে বেতন পরিষ্কার করে উল্লেখ করে দেন নিয়োগদাতারা।’ তিনি জানান, করোনা মহামারির মধ্যে সুপারশপ মীনাবাজার ৮০০ জনের বেশি কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। এ জন্য তারা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় কর্ম অ্যাপে।

ইন্টারনেট আমাকে খুব টানত। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে, এমন কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চাইছিলাম। ইডিএসে বছর দু-এক থাকার পর গুগলের ক্যারিয়ার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গুগলেই আবেদন করলাম। এরপর বহু সাক্ষাৎকার পর্ব শেষে তাদের লন্ডন কার্যালয়ে যোগ দিলাম। সেটা ২০০৮ সালে।
বিকি রাসেল

ঢাকায় বিকি পরিবারের সঙ্গে বনানীতে ওল্ড ডিওএইচএসে থাকতেন। তখন মোটামুটি সব ধরনের খেলার টুর্নামেন্টের আয়োজন করতেন। স্কুলের হয়ে তিনি ক্রিকেটে ঢাকা লিগ এবং জেলা পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। ফুটবলও খেলতেন। আবার ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন বাস্কেটবল লিগেও খেলেছেন। বিকি বলেন, ‘সে সময় জাতীয় দলের ক্রিকেটার হাসিবুল হোসেন শান্ত ছিলেন আমার আইডল। তিনি আবার আমার এলাকার বড় ভাইও ছিলেন।’

খেলতে যাওয়া, ভ্রমণ, নতুন মানুষের সঙ্গে মেশা, সিনেমা দেখা, গান শোনা, বই পড়া—এসব বিষয়ে পরিবার থেকে উৎসাহ দেওয়া হতো বলে জানান বিকি। তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলা দেখি। ফুটবল ক্লাবের মধ্যে আর্সেনালের সমর্থক।’

বিকির কাছে শেষ প্রশ্ন ছিল, এখন যাঁদের ক্যারিয়ার বা পেশাজীবন গড়ার সময়, তাঁদের উদ্দেশে কী বলবেন। তিনি জবাব দিলেন, ‘নতুন কিছু শেখার জন্য সব সময় আগ্রহ থাকতে হবে। সব সময় কৌতূহলী থাকতে হবে। আর কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।’