বিজন কুমার শীলের ‘ওয়ার্ক পারমিট’ পেতে অনিশ্চয়তা

বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীলের দ্রুত ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত। বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে তিনি পর্যটক ভিসায় বাংলাদেশে আছেন। তবে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ না করে লেখালেখি করে সময় কাটাচ্ছেন।

বিজন কুমার শীল
ছবি: প্রথম আলো

বিজন কুমার শীল জন্মসূত্রে বাংলাদেশি হলেও বর্তমানে সিঙ্গাপুরের নাগরিক। তিনি পর্যটক ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন, যার মেয়াদ গত ১ জুলাই শেষ হয়ে যায়। এরপর তিনি নিয়ম মেনে জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে এনভিআর (নো ভিসা রিকোয়ার্ড) ভিসা পরিবর্তনের আবেদন করেন। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রচলিত নিয়ম অনুসারে ড. বিজনকে বিদেশি (অন্য দেশের পাসপোর্টধারী) হিসেবে ‘ই–ভিসা’ (এমপ্লয়মেন্ট ভিসা) করার উপদেশ দিয়েছে এবং তাঁর পর্যটক ভিসার মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিজন শীল এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান পদে যোগ দেন। তিনি ‌‌‌‘অর্থ নিতে পারবেন না’ বলে ভিসায় উল্লেখ করার দিন থেকে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন না। এর আগ পর্যন্ত তিনি অধ্যাপকের পদমর্যাদায় বেতন-ভাতা পাচ্ছিলেন।

বিজন কুমার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ২০১৮ সাল থেকে তিনি বহুবার বাংলাদেশ সফর করেছেন। আগে কখনো ই-ভিসার জন্য দরখাস্ত করেননি। এ বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি সর্বশেষ পর্যটক ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন এবং কোভিড-১৯–এর বিশেষ পরিস্থিতিতে অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি কিটসংক্রান্ত গবেষণায় যুক্ত হন। তবে এবার তিনি তাঁর ভিসায় একটি নতুন বিষয় লক্ষ করেন। ভিসায় যুক্ত করা হয়েছে, ‘এমপ্লয়মেন্ট পেইড অর আনপেইড ইজ প্রহিবিটেড’ (সবেতন বা বিনা বেতনে চাকরি নিষিদ্ধ)।
এটা আসলে আমার একটা ভুল হয়েছে। আমি এ বিষয়ে সচেতন ছিলাম না যে ড. বিজন কুমার শীলের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেই। পরে আমি জেনেছি, সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব পেতে হলে শুধু সেই দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা যায়।’ তিনি বলেন, ‘মর্যাদা বিবেচনায় তাঁকে আমরা স্বপদেই বহাল রেখেছি। শুধু বেতন-ভাতা স্থগিত করেছি। বিডা থেকে বলা হয়েছে, তাঁকে নিয়োগে নতুন করে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। আমরা সেটা কালই দেব। এমন কৃতী বিজ্ঞানী আমরা আরও বেশি নিয়োগ দিতে আগ্রহী
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী , গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি

বিদেশি নাগরিকদের ওয়ার্ক পারমিট দেওয়ার সুপারিশ প্রদানকারী সংস্থা বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) পরিচালক আরিফুল হক বলেন, ‘সবেতন বা বিনা বেতনে চাকরি নিষিদ্ধ’—কথাটি লেখা থাকা বা না থাকার মধ্যে পার্থক্য নেই। কারণ, পর্যটক ভিসাধারী কেউ চাকরি করতে পারেন না।

বিজন শীল বলেন, তিনি এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন না। তবে সর্বশেষ ভিসায় নিষিদ্ধ বিষয়টি দেখামাত্র তিনি তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা আসলে আমার একটা ভুল হয়েছে। আমি এ বিষয়ে সচেতন ছিলাম না যে ড. বিজন কুমার শীলের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেই। পরে আমি জেনেছি, সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব পেতে হলে শুধু সেই দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা যায়।’ তিনি বলেন, ‘মর্যাদা বিবেচনায় তাঁকে আমরা স্বপদেই বহাল রেখেছি। শুধু বেতন-ভাতা স্থগিত করেছি। বিডা থেকে বলা হয়েছে, তাঁকে নিয়োগে নতুন করে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। আমরা সেটা কালই দেব। এমন কৃতী বিজ্ঞানী আমরা আরও বেশি নিয়োগ দিতে আগ্রহী।’

এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, কাগজপত্র ঠিক থাকলে তিনি ওয়ার্ক পারমিট (কাজের অনুমতি) পাবেন। তবে সেটা পেতে হলে পর্যটক ভিসাধারীর মর্যাদা তাঁকে বদলাতে হবে। সে জন্য তাঁকে ই–ভিসা পেতে সিঙ্গাপুরে ফিরতে হবে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাইলে এ নিয়ম শিথিল করে বিজন শীলের ভিসার ধরন বদলাতে পারে।

বিডা কী চেয়েছে

প্রথমটি বাদে তিনটি বিষয়ের অনুকূলে দরকারি কাগজপত্র ৩ সেপ্টেম্বর আমরা জমা দিয়েছি
লায়লা পারভীন, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য

গণ বিশ্ববিদ্যালয় গত ১০ আগস্ট অনলাইনে দরখাস্ত করার পর বিডা তাদের কাছে চারটি মন্তব্য পাঠিয়েছে। ১. ই–ভিসা পেতে তাঁকে বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে আবেদন করতে হবে। তাঁকে তাঁর বহির্গমন সিল দেখাতে হবে। ২. গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজন শীলের নিয়োগসংক্রান্ত কাগজপত্রে যথাযথ সিল ও সই ছিল না। ৩. তাঁকে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগের বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়নি। ৪. ট্যাক্স–সংক্রান্ত রিট পিটিশনটি ২০১৬ সালের। হাইকোর্টের সর্বশেষ আদেশ যুক্ত করতে হবে।

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লায়লা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমটি বাদে তিনটি বিষয়ের অনুকূলে দরকারি কাগজপত্র ৩ সেপ্টেম্বর আমরা জমা দিয়েছি।’

একটি আইনি প্রশ্ন

বিডার ৪ নম্বর শর্তটি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়কর প্রদানসংক্রান্ত। আইনজীবী মুকুন্দ দেবনাথের সই করা একটি বিবৃতি বিডায় জমা দেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, ২০১৬ সালে গণ বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিক ১৫ শতাংশ হারে কর প্রদানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেছিল। বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর শুধু একটি রুল জারি করেছিলেন। কিন্তু শুনানি হয়নি। রুল জারির কারণে গণ বিশ্ববিদ্যালয় কর দেয় না।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, কর না দেওয়ার কারণ মূলত তাদের রিটে পাওয়া উক্ত আদেশ নয়। সরকার দুটি এসআরও জারি করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপ করেছিল। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় দুই ডজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এতে ক্ষুব্ধ হয়। ২০১৬ সালে তারা এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে।

হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই দুটি এসআরওকে ‘অবৈধ ও অসাংবিধানিক’ বলে পুরোপুরি বাতিল করেন। ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করে। আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার একই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে একটি আদেশ দেন। তিনি নির্দিষ্টভাবে শুধু ২০০৭ সালের ১৫৮ নম্বর এসআরওর কার্যকারিতা দুই মাসের জন্য স্থগিত করেন এবং নিয়মিত লিভ পিটিশন দাখিল করার আদেশ দেন। এরপরই গণ বিশ্ববিদ্যালয় পৃথক রিট দায়ের করে ১৫ শতাংশ করারোপের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে।

বিডা সূত্র অবশ্য বলছে, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আরও কিছু তথ্য জানতে চাওয়া হবে। করের প্রশ্নটি কোনো বাধা নয়। কারণ, ভারতীয় শিক্ষাবিদ শংকরণ নামবুধারীকে ই–ভিসা দেওয়া হয়েছে। নামবুধারী বর্তমানে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন।