বিজয়ের আগের দিনগুলো

ফাইল ছবি

১ ডিসেম্বর ১৯৭১। তারায় তারায় খচিত আকাশের নিচে কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাত। থমথমে নৈঃশব্দ ভেঙে থেকে থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিপোকার ডাক। বিশাল বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে জোনাকি পোকার রহস্যময় আনাগোনা।

স্থান আখাউড়ার অদূরে তিতাস নদের তীরঘেঁষা সিংগাইর বিল, মুকুন্দপুর ও আজমপুর। এই পুরো এলাকা তখন পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ পাঠান রেজিমেন্ট তথা ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স-এর দখলে। আর এই এলাকাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য এখানে জড়ো হয়েছে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৮০০ পোড়খাওয়া মুক্তিসৈনিক। এদের প্রায় সবাই ইতিমধ্যে ৯ মাস ধরে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। মুকুন্দপুরের উল্টো দিকে তাদের অবস্থান। পেছনে আগরতলা বিমানবন্দর।

একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কোম্পানি অধিনায়কদের সঙ্গে আমি আক্রমণের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি পরীক্ষা করছিলাম। আমার শরীরে তখন অজানা বিপদের অনুভূতি। এই তো চার মাস আগেই ময়মনসিংহের কামালপুরে মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের যুদ্ধে চোখের সামনে শহীদ হতে দেখেছি ৩৫ জন সহযোদ্ধাকে। যদিও প্রতিটি খড়িতে আঁকা (সেট পিস) যুদ্ধের আঙ্গিক ভিন্ন, ভিন্ন তার ক্ষেত্র ও পরিবেশ। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এ রকম যুদ্ধে রক্তপাত, একাধিক মৃত্যু এবং ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। সহযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, ভোর না হতেই হয়তো অনেকের মুখেই অমোঘ মৃত্যুর ছায়া পড়বে। আসলে অবচেতন মনে মৃত্যুচিন্তা যোদ্ধার নিত্যসঙ্গী। কিন্তু একজন অধিনায়ক মৃত্যুর এই ভাবনাকে ক্রমাগত পরাজিত করেন। তিনি সব ভয়কে লুকিয়ে রাখেন আশাবাদী আচরণের আড়ালে।

ফরাসি আলোকচিত্রী মার্ক রিবুর তোলা ১৯৭১ সালের ছবি
ছবি সংগৃহীত

আগেই ঠিক করা ছিল, রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে ভারতীয় গোলন্দাজরা আমাদের আক্রমণে সহায়তা করার জন্য আগরতলা বিমানবন্দরের পেছন থেকে দূরপাল্লার ভারী কামানের গোলাবর্ষণ শুরু করবে। চারদিকের নৈঃশব্দ্য ভেঙে ঠিক সময়েই তা ঘটল। ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর লক্ষ্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১২ নম্বর এফএফ রেজিমেন্ট। আমাদের আক্রমণে সহায়তার জন্য সেদিন ভারতীয় বাহিনী গোলা নিক্ষেপে কোনো কার্পণ্য করেনি। গোলাবর্ষণের প্রচণ্ডতা ও তীব্রতা ছিল এমন যে অনেক দূরেও আমাদের পায়ের নিচের মাটি কাঁপছিল। আমার নেতৃত্বাধীন ব্যাটালিয়ন গোলাবর্ষণের সহায়তায় দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। শত্রুদের হটিয়ে তিতাস নদের পাড়, মুকুন্দপুর, সিংগাইর বিল আর আজমপুর মুক্ত করাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। শত্রুবাহিনী থেকে ৪০০ মিটার দূরে থাকতেই পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে বন্ধ হয়ে যায় দূরপাল্লার কামানের গোলাবর্ষণ। এরপর আমাদের সৈন্য এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে শুরু হয় মেশিনগান আর রাইফেলের অবিরাম গোলাগুলি।

কুয়াশায় ঢাকা সে রাতে যুদ্ধ পরিচালনা ছিল অত্যন্ত কঠিন। ভোর না হতেই শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাদের তুমুল পাল্টা আক্রমণ। দূরপাল্লার ভারী কামান, মেশিনগান ও দুটো ‘এফ-৮৬ সেবর জেটের’ সাহায্যে তাদের এই পাল্টা আক্রমণ ছিল এক কথায় প্রচণ্ড। ২ ডিসেম্বর সারা দিন ধরে এ যুদ্ধ চলে। শেষ অবধি আমাদের পিছু হটাতে না পেরে ৩ ডিসেম্বর ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যায়। ফলে সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল ও মহাসড়কের মনতলা, হরশপুর, মুকুন্দপুর থেকে শাহবাজপুর পর্যন্ত পুরো এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

সেদিনের সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হারিয়েছি অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে। এর মধ্যে মনে পড়ে ব্রাবো (বি) কোম্পানির কমান্ডার লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামানের নাম। যুদ্ধ চলাকালেই তাঁকে আজমপুর রেলস্টেশনের পাশে সমাহিত করা হয়। এই মহান মুক্তিযোদ্ধার নামে ঢাকা সেনানিবাসে একটি সড়কের নামকরণ করা হয় ১৯৭২ সালে। কিন্তু সম্প্রতি এই সড়কটির নাম পরিবর্তন করে ‘স্বাধীনতা সরণি’ রাখা হয়েছে। বদিউজ্জামানকে যেখানে সমাহিত করা হয়, সেই আজমপুর রেলস্টেশনের নামকরণ করা হয়েছিল তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সুবেদার আজমের নামে। তিনি একজন পশ্চিম পাকিস্তানি ছিলেন। ষাটের দশকে ওই সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে তিনি নিহত হন। যাহোক, সুবেদার আশরাফসহ আরও আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আখাউড়া যুদ্ধে শহীদ হন, যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে সেদিন আমরা একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত করতে সক্ষম হই। এ ছাড়া ২০ জনের অধিক মুক্তিসৈনিক সে যুদ্ধে আহত হন। অন্যদিকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ১২ এফএফের তিনজন সৈনিক আমাদের হাতে বন্দী হয়। আর পালানোর আগে তাদের ফেলে যেতে হয় ১২টি মৃতদেহ।

ওই যুদ্ধের সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে। উদ্দেশ্য ছিল, পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় ট্যাংক ও সেনাবাহিনী যেন অতি সহজে এ এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও মেঘনা নদীর পাড়ের আশুগঞ্জ পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারে। তাই এ যুদ্ধের গুরুত্ব অনুধাবন করে ভারতীয় বাহিনীর তৎকালীন পূর্বাঞ্চলের জিওসি মেজর জেনারেল গণজালভেস এ সম্পর্কে নভেম্বর মাসের শেষ দিকে আমার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

এর পরের তিন দিন অর্থাৎ ৪ থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা শাহবাজপুর এলাকায় ছিলাম। সীমান্তবর্তী অঞ্চল বিধায় যুদ্ধের প্রথম দিকেই বেশির ভাগ লোক ভারতে এবং কিছু লোক দূরদূরান্তে গ্রামাঞ্চলের দিকে চলে যায়। ফলে ওই সময় পুরো এলাকা প্রায় জনশূন্য ছিল। তাই সৈনিকদের খাবারদাবার জোগাড় করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। তবু স্থানীয় দু–একজন যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।

ঢাকা দখলের অভিযান

৭ ডিসেম্বর আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসি এবং প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করি। ভারতীয় বাহিনী এই সময়টাতে আশুগঞ্জে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ১১ তারিখ পর্যন্ত আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও এর আশপাশে অবস্থান গ্রহণ করি। পাকিস্তানি বাহিনী তখন পাকিস্তানের ২৭ ব্রিগেডের জাঁদরেল ব্রিগেডিয়ার সাদউল্লাহ্র নেতৃত্বে আশুগঞ্জ ও ভৈরব বাজারে অবস্থান নেয়। সাদউল্লাহ্‌কে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানতাম। তাঁর সঙ্গে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশনে একসঙ্গে চাকরি করেছি। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একজন অত্যন্ত সাহসী ও স্বনামধন্য অফিসার হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

আমরা ওই কদিন পুরো এলাকায় প্যাট্রলিং করি এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। ৯ ডিসেম্বর দুপুরে ভারতের ১০ বিহার রেজিমেন্ট আশুগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। ওই আক্রমণ পাকিস্তানিরা বেশ ভালোভাবে প্রতিহত করে। এই সংঘর্ষে ভারতীয় বাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেক সৈন্য নিহত ও আহত হয়। ১০–১১ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ভৈরব ব্রিজটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয় এবং আশুগঞ্জ থেকে মেঘনা অতিক্রম করে ভৈরবে গিয়ে অবস্থান নেয়। ভৈরবে তারা শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি সর্বাত্মক জনযুদ্ধ

১২ তারিখ ভোরে ভারতীয় বিমানবাহিনী ভৈরবে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। বেশ কিছু হেলিকপ্টার ওই দিনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৎকালীন নিয়াজ স্টেডিয়ামে অবতরণ করে এবং ভারতীয় ১০ বিহার রেজিমেন্টের সৈন্যদের নরসিংদী নিয়ে যেতে থাকে।

আমাকে বলা হলো, আমি যেন নৌকাযোগে মেঘনা নদী পার হয়ে আমার পুরো রেজিমেন্ট নিয়ে ভৈরব বাজার এড়িয়ে নরসিংদী পৌঁছার চেষ্টা করি। ওই দিনই বেলা ১১টায় আমরা নৌকা জোগাড় করে আরও দক্ষিণ-পশ্চিমে সরে গিয়ে পুরো রেজিমেন্ট নিয়ে মেঘনা নদী পাড়ি দিই। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের লক্ষ্য করে দূরপাল্লার কামান থেকে গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। দিনের বেলায় এই গোলাগুলির ভেতর দিয়ে আমরা নদী পার হই এবং মেঘনার পশ্চিম পাড়ে এসে উঠি। এরপর রেললাইন ধরে হেঁটে নরসিংদী পৌঁছাই। আমরা নরসিংদী রেলস্টেশনের আশপাশে অবস্থান নিই। ভারতীয় বাহিনী হেলিকপ্টারে এসে আগেই সেখানে অবস্থান গ্রহণ করে।

লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ায় সৈন্যরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ওই রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা (বর্তমান সংসদ সদস্য) রাজিউদ্দীন রাজু আমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ১ ডিসেম্বরের পর এটাই ছিল আমাদের জন্য একটি পরিপূর্ণ এবং ভরপেট খাবার। তবে এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভাত খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।

১৩ তারিখ বিকেলে আমি লেফটেন্যান্ট সাঈদের (বর্তমানে মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে ঢাকার দিকে একটি টহল দল পাঠাই। টহল দল ফিরে এসে আমাকে জানায়, ঢাকা থেকে লোকজন গ্রামের দিকে চলে আসছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে বুঝতে পারি, পাকিস্তানি বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় এসে জড়ো হচ্ছে এবং ঢাকার চারদিকে অবস্থান গ্রহণ করছে।

ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ি। বলতে গেলে পুরো রাতই আমার নিদ্রাহীনভাবে কাটে। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, ঢাকা দখলের জন্য বোধ হয় আমাদের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ (স্ট্রিট ফাইটিং) করতে হবে। শহরের ভেতরে এ ধরনের যুদ্ধ সম্পর্কে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁরা হয়তো বুঝতে পারবেন, এ ধরনের যুদ্ধ কী রকম ভয়াবহ। এতে উভয় পক্ষই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং বেসামরিক নাগরিকেরাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের তীব্রতায় পুরো শহর পরিণত হতে পারে ধ্বংসস্তূপে।

সমগ্র নরসিংদী এলাকায় মিত্রবাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন ও আমার এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য মোতায়েন ছিল সে সময়। ৪ ডিসেম্বর ভারতের যুদ্ধ ঘোষণার পর থেকেই ঢাকা দখলের যে পরিকল্লনা নেওয়া হয়, তারই প্রেক্ষাপটে আমাদের সেনারা সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিল। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ও ভারতীয় সরকারের মতৈক্যের ভিত্তিতে সে সময় সিদ্ধান্ত হয় যে অপারেশন ‘জ্যাকপট’ (ঢাকা অভিযানের সাংকেতিক নাম) চলাকালে এলাকায় দুই বাহিনীর মধ্যে যে অফিসার ওই এলাকায় সিনিয়র হবেন, তিনিই যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক হবেন। মূলত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভারতীয় বাহিনীর অফিসার সিনিয়র থাকায় তাঁরাই অধিনায়ক ছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতীয় যৌথ বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে ব্রিগেডিয়ার মিশ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমার সঙ্গে যোগ দেন।

ভারতীয় কমান্ড অগ্রাহ্য করে

১৩ ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার মিশ্র আমাকে নরসিংদীতে অবস্থান করে সেখানকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখতে বলেন। আমি তাঁর কথায় কোনো সাড়া না দিয়ে আমার ব্যাটালিয়ন নিয়ে রাতের বেলায় সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকি। আমার মনে পড়ল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বার্লিন দখলের জন্য মিত্রবাহিনীর প্রতিযোগিতার কথা। সেখানে কে আগে পৌঁছে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে, তা নিয়েই রুশ ও অন্যান্য মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়েছিল। তাই আমরা ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম।

১৪ তারিখ দুপুরবেলায় আমরা ঢাকার অদূরবর্তী ডেমরায় পৌঁছাই। আমার সঙ্গে নিয়মিত বাহিনী দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৮০০ সৈনিক ছিল। ৩ নম্বর সেক্টরের কিছু মুক্তিযোদ্ধা, যাঁরা আমাদের সঙ্গে রায়পুরায় যোগ দেন, তাঁরাও ডেমরায় সমবেত হন। আমরা ডেমরা শিল্পাঞ্চলের পেছনে অবস্থান গ্রহণ করি। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আমাদের থেমে থেমে গোলাগুলি চলতে থাকে। তবে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান ছিল বেশ দুর্বল। ভারতীয় বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন তখন আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থান নেয়। অন্য একটি ব্যাটালিয়ন নরসিংদীর পূর্ব দিকে টঙ্গী বরাবর অবস্থান নেয়।

১৫ তারিখ রাতে আমি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনিসের (বর্তমানে ডাক্তার) নেতৃত্বে ২০–২৫ সদস্যের একটি ফাইটিং প্যাট্রল বাড্ডার দিকে পাঠাই। তারা সেখানে আধা ঘণ্টার মতো অবস্থান করে এবং ১০–১৫টি ৮১ মিলিমিটার মর্টারের গোলা ঢাকার দিকে তথা গুলশানের দিকে লক্ষ্য করে ছোড়ে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী এর কোনো পাল্টা জবাব দেয়নি।

১৬ ডিসেম্বর সকালে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে অবস্থানরত সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পারি, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। একটু পরে সে খবরের সত্যতা সরকারিভাবে জানতে পারি। আমার সৈন্যরা পায়ে হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদী হয়ে ডেমরা পৌঁছে এবং পথে পথে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করে স্বভাবতই ছিল ক্লান্ত ও দীর্ঘ পথযাত্রায় দুর্বল। তাই সকালে ডেমরায় একটি বাড়িতে ভারী কামান ও গোলাবারুদ রেখে আমরা ডেমরার প্রধান সড়কে উঠি। আমাদের পরনে খাকি পোশাক। কারণ, যুদ্ধকালীন কোনো সৈন্য ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় না থেকে বেসামরিক পোশাকে যুদ্ধবন্দী হলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবে না, বরং দুষ্কৃতকারী হিসেবে গণ্য হবে। তা ছাড়া শৃঙ্খলা এবং সার্বিক নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত বাহিনীর পোশাক থাকা একান্ত আবশ্যক। যাহোক, ডেমরা থেকে আমরা খাকি পোশাকে ডান দিকের রাস্তা ধরে যাচ্ছিলাম। বাঁ দিকের রাস্তায় দেখি অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর আমাকে জড়িয়ে ধরেন। তাঁর সঙ্গে আমি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে পরিচিত। ভগ্ন-মনোরথ মেজর আমাকে বোঝাতে চাইছিলেন যে তাঁর রেজিমেন্ট সাধারণ জনগণের ওপর কোনো রূপ নির্যাতনমূলক আচরণ করেনি। কোনো রূপ প্রত্যুত্তর না করে আমি আমার পথে ঢাকার দিকে চলতে লাগলাম। একটু পরে দেখি ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং মেজর হায়দারকে (পরে ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে নিহত) নিয়ে গাড়ি করে বেসামরিক পোশাকে ঢাকার দিকে যাচ্ছেন। এদিকে ওই দিনই এয়ার ভাইস মার্শাল আবদুল করিম খন্দকারও কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন মিত্রবাহিনীর সঙ্গে। ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের ছবিতেও তাঁদের দেখা যায়। উল্লেখ্য, ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং ১৯৮৪ সালের অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরের সংঘর্ষে ভারতীয় বাহিনীর হাতে মন্দিরের ভেতরে নিহত হন। ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি ছিলেন উগ্রপন্থী শিখনেতা সন্তু ভিন্দ্রানওয়ালের সামরিক উপদেষ্টা।

সন্ধ্যার দিকে আমরা ঢাকা পৌঁছাই। রাস্তার দুই পাশের বাড়ির ছাদে অসংখ্য কৌতূহলী মানুষ আমাদের স্বাগত জানায়। অনেকে অবশ্য আমাদের খাকি পোশাকে দেখে অবাকই হয়। কারণ, আমাদের এবং পাকিস্তানি বাহিনীর উভয়ের পোশাকই ছিল খাকি। ফলে তারা কিছুটা ভীতসন্ত্রস্তও ছিল। যাহোক, আমাদের চিনতে তাদের কিছুটা সময় লাগে।

মুক্ত নগরী ঢাকা

সন্ধ্যায় আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছি। স্টেডিয়ামের পথে পথে রাস্তাঘাট ছিল জনশূন্য। যদিও পাকিস্তানি আর্মি আত্মসমর্পণ করেছিল তথাপি লোকজনের মধ্যে ভয়ভীতি, আতঙ্ক ও সন্দেহ ছিল। তাই রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল ছিল না। ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছার আগে সন্ধ্যায় জানতে পারি, ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের আশপাশে পাকিস্তানি আর্মি উৎসুক জনসাধারণের ওপর গুলি চালিয়েছে। ফলে কিছু লোক হতাহত হয়েছে।

আমি ঠিক করলাম আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামেই অবস্থান নেব। কারণ, ঢাকা স্টেডিয়াম সুরক্ষিত, আচ্ছাদিত এবং ৮০০ লোকের থাকাসহ আনুষঙ্গিক সুবিধাদি এখানে বিদ্যমান। তদুপরি ক্ষুধা এবং দীর্ঘ পথ চলার কারণে সবাই পরিশ্রান্ত ছিল। তাই ঢাকা স্টেডিয়ামে আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করি। ৩০ নভেম্বরের পর থেকে যুদ্ধ পরিস্থিতি ও সুষ্ঠুভাবে রসদ পরিবহনের অভাবে আমাদের ভালোভাবে খাওয়াদাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তা ছাড়া পায়ে হেঁটে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আমাদের চলতে হয়েছে। তাই একই সঙ্গে পর্যাপ্ত রসদ নিয়ে পথ চলাও সম্ভব ছিল না।

১৬ ডিসেম্বর রাতেই লেফটেন্যান্ট সাঈদ (বর্তমানে মেজর জেনারেল) ও কয়েকজন সৈনিকসহ আমি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যাই। তখন হোটেলটি ছিল নিরপেক্ষ এলাকা। সেখানে রেডক্রসের পতাকা উড্ডীয়মান ছিল। সেখানে গিয়ে দেখলাম পরিস্থিতি থমথমে, শান্ত ও নীরব। হোটেলে গিয়ে উপস্থিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ করলাম। তাদের বেশ ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। আমাদের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র দেখে হয়তো তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। নিরপেক্ষ এলাকা হওয়ায় আমাদের সেখানে অস্ত্র নিয়ে ঢোকা উচিত হয়নি। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি বেশ লজ্জিত হয়ে পড়ি।

ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনের রাস্তায় তখনো রক্তের দাগ ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে কী হয়েছিল, তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, বিজয়ের পর উৎসুক জনতা হোটেলের সামনে ভিড় জমায়। পলায়নরত পাকিস্তানিরা তখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গুলি ছোড়ে। আমরা গিয়ে সেখানে কাউকে পাইনি। পরে আমরা হোটেল থেকে ফিরে আসি।

পরদিন (১৭ ডিসেম্বর) অতি প্রত্যুষে ঢাকা স্টেডিয়ামে তৎকালীন বিখ্যাত শাড়ির দোকান পাবনা স্টোরের মালিক (নাম মনে নেই) আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসেন। প্রায় ৮০০ সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকের জন্য খাবার তৈরি করতে প্রায় সারা রাত লেগে যায়। অবশ্য বাকি যে তিন দিনের মতো আমরা সেখানে ছিলাম, সে সময় জনসাধারণ এবং ঢাকার তৎকালীন জেলা প্রশাসক আহমেদ ফরিদের (পরে সচিব ও রাষ্ট্রদূত, বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন) সহযোগিতায় খাবারের বন্দোবস্ত হতো।

সকালেই স্টেডিয়াম থেকে দেখতে পাই শহরে প্রচুর লোকসমাগম। তাদের অনেকেই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এবং গাড়ি করে ও পায়ে হেঁটে শহরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের দেখে মনে হয়নি গত ৯ মাসে কখনো তারা বৃষ্টিতে ভিজেছে বা রোদে ঘেমেছে। তাদের বেশভূষা, চালচলন ও আচরণে যুদ্ধের কোনো ছাপ ছিল না।

১৭ ডিসেম্বরে লুটপাট

দুপুরবেলায় জিন্নাহ অ্যাভিনিউতে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) লুটপাট আরম্ভ হয়। আমি এবং আমার অধীন সব সৈনিক স্টেডিয়াম থেকেই তা প্রত্যক্ষ করলাম। কিন্তু এ সময় আমাদের করণীয় কিছুই ছিল না। কারণ, ঢাকা শহরের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের ভার অর্পিত ছিল ভারতীয় বাহিনীর হাতে। পরে জানতে পারি, নিউমার্কেট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকায়ও ওই দিন লুটতরাজ হয়। এ লুটতরাজের জন্য অন্যদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীকেও দোষারোপ করা হয়। তবে আমাদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির ফলে ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকায় কোনো প্রকার লুটতরাজ হয়নি। সে সময় ভারতীয় বাহিনীর অবস্থান ছিল রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান), ঢাকা সেনানিবাস, বিশ্ববিদ্যালয়, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর, মিরপুরসহ অন্যান্য কিছু এলাকায়। সে সময় বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর মধ্যে শুধু আমার দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টই ছিল ঢাকা শহরে। তখন পর্যন্ত আর কোনো বাংলাদেশি নিয়মিত বাহিনী ঢাকায় এসে পৌঁছেনি।

ওই সময়টাতে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। নরসিংদী থেকে নিজ দায়িত্বে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করায় তারা হয়তো আমার ওপর অসন্তুষ্ট ছিল। আমার সঙ্গে তাদের আচরণে আমি তা বুঝতে পারি।

দুপুরের পর আমি ঢাকা সেনানিবাসে গেলাম। আমার সঙ্গে কয়েকজন সৈন্য ছিল। আমরা সেখানে ঘণ্টাখানেক ঘোরাফেরা করি। সেনানিবাসে সর্বত্রই তখন ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতি। আমাকে দেখে বরং তারা অবাকই হলো। কয়েকটি ব্যারাকে গিয়ে দেখি সেখানে বন্দী পাকিস্তানি সৈনিক। জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ অন্য কিছু সেনা অফিসারকে তৎকালীন স্কুল রোডের (বর্তমানে স্বাধীনতা সরণি) এক বাড়িতে দেখলাম। পরে আমি সেন্ট্রাল অর্ডন্যান্স ডিপোতে (আর্মির কেন্দ্রীয় গোলাবারুদ ও রসদপত্রের স্টোর) গেলাম। আমাকে ডিপোতে প্রবেশ করতে বেশ বেগ পেতে হলো। পরিচয় প্রদানের পর কর্মরত ভারতীয় মেজর আমাকে ডিপোতে প্রবেশ করতে দিলেন। সেখানে প্রচুর রসদ ও আনুষঙ্গিক স্টক থাকার কথা থাকলেও তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ছিল না। আমি কিছু তাঁবুর ব্যবস্থা করলাম আমার সৈনিকদের জন্য। সন্ধ্যার দিকে আমি সেনানিবাস ত্যাগ করি।

ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছে দেখি, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁরা ব্যাংক লুটের আশঙ্কা ও নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন বলে আমাকে অবহিত করেন। আমি যেন ব্যাংকের সঠিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করি, সে অনুরোধও জানান। আমি তাঁদের স্থানীয় পুলিশ স্টেশন তথা রমনা থানার সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দিই, যদিও আমি জানি আইনশৃঙ্খলার অস্তিত্ব নেই। ব্যাংকের পূর্বাপর অবস্থা সম্পর্কেও আমি অবহিত নই। তা ছাড়া ঢাকা শহরের নিরাপত্তার দায়িত্বে তখন ভারতীয় বাহিনী। সুতরাং এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা না জেনে দায়দায়িত্ব নিতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না।...

ভারতীয় সেনাদের অহংবোধ

ওই সময় ঢাকায় ভারতীয় বাহিনীর কিছু কিছু অফিসারের কার্যকলাপে আমার মনে হয়েছে, তারা যেন নিজেদের বাংলাদেশের ত্রাতা হিসেবে গণ্য করছে। একধরনের অযাচিত অহংবোধ নিয়ে তারা ঢাকায় চলাফেরা করত। ঠিক এ ধরনের মানসিকতার জন্যই পাকিস্তানিদের সঙ্গে বাঙালিদের, বিশেষ করে আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন আর্মি অফিসারদের সৌহার্দ্যপূর্ণ বা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বরং তাদের প্রতি একধরনের অবিশ্বাস ও বিতৃষ্ণা ছিল। আসলে একজন গর্বিত সৈনিকের আত্মমর্যাদাবোধটাই বড়। এটা না থাকলে কেউ দেশের জন্য, জাতির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পারে না। তবে ওই সময় ভারতীয় বাহিনীর সেসব অবাঞ্ছিত আচরণের জন্য কিছু বাঙালি এবং মুক্তিযুদ্ধের তথাকথিত নেতাগোছের কিছু লোকও দায়ী।

প্রসঙ্গক্রমে ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই ময়মনসিংহের উত্তরে কামালপুরে সংঘটিত যুদ্ধের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। কামালপুরে কয়েক ঘণ্টার এক যুদ্ধে আমি হারিয়েছি প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। আরও ৫৭ জন মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিলেন আহত। পরদিন ১ আগস্ট হেলিকপ্টারযোগে জেড ফোর্সের (যার অধিনায়ক ছিলেন জিয়াউর রহমান) হেডকোয়ার্টারে আসেন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল (পরে ফিল্ড মার্শাল) মানেকশ। তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বললেন এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। কথা প্রসঙ্গে আমি মানেকশকে আমাদের ওয়্যারলেস সেটের স্বল্পতা এবং কামালপুর যুদ্ধের সময় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সরবরাহকৃত ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনে সমস্যার কথা জানাই। মূলত ওয়্যারলেস সেট কাজ না করায় ওই যুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুবের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হই। ক্যাপ্টেন মাহবুব ওই সময় স্থানীয় পাকিস্তানি ঘাঁটির পেছনে তাঁর সৈন্যদের নিয়ে আমার আদেশের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ওয়্যারলেস সেট কাজ না করায় তাঁর কাছে সময়মতো আদেশ পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ওই কোম্পানিটিকে সক্রিয় করতে পারলে সেদিনের যুদ্ধে আমাদের এত ক্ষয়ক্ষতি হয়তো হতো না। যুদ্ধের শেষ দিকে ক্যাপ্টেন মাহবুব সিলেটে শহীদ হন।

যাহোক, জেনারেল মানেকশর সঙ্গে আমার কথোপকথনের সময় ওই অঞ্চলে গারো পাহাড়ের তুরা শহরে অবস্থিত ভারতীয় ১০১ কমিউনিকেশন জোনের কমান্ডার মেজর জেনারেল গুরবত সিং গিল উপস্থিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন শিখ। আমার সঙ্গে তাঁর বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশের সামরিক অধিনায়কদের সঙ্গে তিনিই ভারতীয়দের পক্ষে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং প্রয়োজনে রসদ সরবরাহ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। মানেকশ চলে যাওয়ার পর তিনি আমাকে তুরায় তাঁর হেডকোয়ার্টারে চায়ের আমন্ত্রণ জানান। সেখানে গেলে তিনি অনুযোগ করে আমাকে বলেন, তোমাদের প্রয়োজনমতো সব সময় যা চেয়েছ আমি সাহায্য করেছি। তবু তুমি আমার সেনাপ্রধানের কাছে রসদ নিয়ে অভিযোগ করলে!

আমি তাঁকে আশ্বস্ত করে বললাম, এসব ওয়্যারলেস তো আর তুমি তৈরি করো না। আমি শুধু ওয়্যারলেস সেটের কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। আমি তাঁকে আরও বললাম, একজন পেশাদার ও স্ট্রেট ফরওয়ার্ড জেনারেল হিসেবে আমি তোমাকে পছন্দ করি এবং সম্মান করি। এই সুযোগে আমার নিজের অনুভূতি তোমাকে জানাতে চাই। আমি সরাসরি তাঁকে বললাম, ১৯৪৮ ও ১৯৬৫ সালে তোমরা পাকিস্তানের সঙ্গে দুটো যুদ্ধ করেছ। দুটি যুদ্ধই ছিল অসমাপ্ত এবং তা থেকে তোমরা কিছুই পাওনি (জিরো সাম গেম), এই ’৭১-এ এসে তোমরা পেয়েছ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় সুযোগ, পাকিস্তানকে ভাঙার। সহজ কথা হলো, তোমরা চাও পাকিস্তানকে ভাঙতে, আর আমরা চাচ্ছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তাই তোমাদের নিজেদের স্বার্থেই সর্বাত্মকভাবে আমাদের সাহায্য করা উচিত।

গিল হেসে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘মইন, তুম বহুত চাল্লু হ্যায়!’ অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে ডিসেম্বর মাসে সেই কামালপুরেই যুদ্ধ পরিচালনার সময় এই বীর ভারতীয় জেনারেল গুরুতরভাবে আহত হন।...

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

৮ জানুয়ারি ১৯৭২ ঢাকায় খবর আসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে যাচ্ছেন। এ খবরে ঢাকাসহ সারা দেশে জনসাধারণের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকায় লোকজন রাতভর আনন্দ মিছিল, আতশবাজি ও ফাঁকা গুলিবর্ষণের মধ্য দিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকেই তা দেখলাম। পরদিন ৯ জানুয়ারি সকালে প্রধান সেনানায়ক কর্নেল ওসমানী (পরে জেনারেল) তৎকালীন কর্নেল সফিউল্লাহর মাধ্যমে আমাকে জানান, শেখ মুজিবের গার্ড অব অনার আমাকে পরিচালনা করতে হবে, তেজগাঁও বিমানবন্দরে। নির্দেশ পেয়ে ওই দিনই সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রায় ৫০০ সদস্য সংগ্রহ করি। তাদের নিয়ে আমি তেজগাঁও বিমানবন্দরে গার্ড অব অনারের অনুশীলনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবের কাঙ্ক্ষিত স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন। আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী ও আপাময় জনসাধারণের ঢল নামে বিমানবন্দরে। প্রচণ্ড ভিড় সেখানে। এত ভিড়, এত মানুষ এর আগে আমি কোথাও দেখিনি। বিকেলে শেখ মুজিবকে নিয়ে যুক্তরাজ্যের সাদা রঙের রাজকীয় বিশেষ বিমান ঢাকায় অবতরণ করে। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এ প্রতিযোগিতা ছিল সত্যিই দৃষ্টিকটু। শেখ মুজিবের জন্য তৈরি মঞ্চেও ভিড়। এ ভিড়ের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে গার্ড অব অনার দেওয়াও একরকম দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াল। যাহোক, ভিড় ঠেলেই আমরা গার্ড অব অনার দিলাম।

অত্যন্ত কাছ থেকে শেখ মুজিবকে এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো দেখলাম। এর আগে ১৯৬৯ সালে তৎকালীন শাহবাগ হোটেলে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) গণচীনের আবাসিক কনসাল জেনারেলের অভ্যর্থনায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। তখন আমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজার এডিসি। যাহোক, গার্ড অব অনার দেওয়ার সময় মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধান সেনানায়ক কর্নেল ওসমানীও ছিলেন। গার্ড অব অনার শেষে শেখ মুজিব আমাকে বললেন, ‘তোমরা কেমন আছ?’ বিমানবন্দরজুড়ে গগনবিদারী স্লোগানের জন্য তাঁর বাকি কোনো কথা শুনতে পেলাম না। গার্ড অব অনার শেষে ভিড়ের মধ্যেই শেখ মুজিবকে জিপে তুলে রেসকোর্স ময়দানে আনা হয়। রেসকোর্স ময়দানের সার্বিক তত্ত্বাবধান ছিল আমার দায়িত্বে। কারণ, আগেই বলেছি আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল সেখানে। ভিড় উপেক্ষা করে আমি রেসকোর্সের পাশে অবস্থিত আমার অস্থায়ী কার্যালয়ে ফেরত আসি। সেখানে তখন লাখ লাখ লোকের সমাবেশ। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আমি দেখি প্রচণ্ড সেই ভিড় ঠেলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মঞ্চের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আমি তাঁকে মঞ্চে পৌঁছে দিয়ে আসি। সেদিন রেসকোর্সে শেখ মুজিব ভাষণ দেন, যা সম্পর্কে সবাই অবহিত আছেন।

পরদিনও (১১ জানুয়ারি) শহরে দিনভর আনন্দ মিছিল চলতে থাকে। আমি আমার অস্থায়ী কার্যালয়ে ব্যস্ত দিন কাটাই। ওই দিনই আমাকে জানানো হয়, নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে আমাকে রাস্ট্রপতির সামরিক সচিবের দায়িত্ব পালন করতে হবে। সামরিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে স্বভাবতই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমার সক্রিয় থাকার কথা। কিন্তু শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পরার মতো সামরিক সচিবের ইউনিফর্ম আমার ছিল না। আমি তা বঙ্গভবন থেকে সংগ্রহ করি। সেখানে গিয়ে দেখি প্রচুর লোকের ভিড়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ভারত থেকে এসে পরিবার–পরিজন নিয়ে বঙ্গভবনে উঠেছিলেন এবং সেখানেই থাকতেন। যাহোক, আমি স্বভাবতই ভাবলাম শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেবেন। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় মেহেরপুরে বাংলাদেশের যে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়, তাতে তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শপথ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা করতে চাইলে তিনি ইঙ্গিত দিয়ে দেখালেন যে আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হবেন। বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে কিংবা পরেও আমাকে বলা হয়নি, কে হবেন দেশের রাষ্ট্রপতি আর কে হবেন প্রধানমন্ত্রী।

জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব অফিসে যাওয়ার পথে একদিন আকস্মিকভাবে রেসকোর্স ময়দানে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল ইউনিট পরিদর্শনে আসেন। তিনি ঘণ্টা দেড়েক ঘোরাফেরা করার পর আমার কক্ষে আসেন এবং খোলাখুলিভাবে আমাদের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে জানতে চান। আমি তাঁর সঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করি। এ ছাড়া আমরা যেন সত্বর ক্যান্টনমেন্টে যেতে পারি, সে ব্যবস্থা করার জন্যও আমি তাঁকে অনুরোধ করি। কারণ, আমরা দীর্ঘদিন থেকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার বাইরে ছিলাম। সৈনিকেরা তাদের পারিবারিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা–সাক্ষাৎ করা ছিল একান্তভাবে জরুরি। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা মূল বেতনের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পেতাম। বাকি দুই–তৃতীয়াংশ মেয়াদি সঞ্চয়পত্র আকারে পেতাম। আমাদের কোনো নিজস্ব কাপড়চোপড়, আসবাবপত্র ছিল না। আমরা মার্চ মাসে যখন জয়দেবপুর থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগদান করি, তখন আমাদের ব্যক্তিগত সব জিনিসপত্র সেখানে ফেলে রেখে আসি। শুধু সামরিক পোশাক, অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগদান করি। ৯ মাস পর দেশে ফিরে এসে জয়দেবপুরে আমাদের ফেলে যাওয়া ব্যক্তিগত গাড়ি, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে কোনো কিছুই আর পাওয়া যায়নি। এতে বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিভিন্ন স্তরের সৈনিকেরা। তারা তাদের সারা জীবনের সঞ্চয় ফেলে এক কাপড়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। তাদের ওই ক্ষতি ছিল অপূরণীয়। কারণ তাদের অধিকাংশই এসেছে বাংলার বিভিন্ন কৃষক পরিবার থেকে।

শেখ মুজিবের সঙ্গে কথোপকথনে আমার মনে হয়েছিল তিনি এক বিরাট ব্যক্তিত্বের অধিকারী। অগাধ দেশপ্রেম এবং সততা তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। আমার জীবনে বহু উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি ও নেতাকে একান্ত কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, শেখ মুজিব ব্যতিক্রমী এক মানুষ, যাঁর হৃদয় ছিল অত্যন্ত কোমল, সাদামাটা। তিনি এক খাঁটি বাঙালি দেশপ্রেমিক। তবে সে সময় তাঁকে কথোপকথনের ফাঁকে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক দেখেছি। আমি যখন অস্ত্র উদ্ধার, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করি, তখন তিনি গভীরভাবে শুনছেন কিংবা গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে আমার মনে হয়নি। তিনি সুদীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটানোর পর দেশে এসে হয়তো আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মানসিকভাবে চিন্তামগ্ন আছেন বলে মনে হয়েছে। কিংবা হতে পারে দেশে ফেরার পর ৯ মাসের যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি এবং ঘটনাবলি কেউ তাঁকে সত্যিকারভাবে বলেনি। যাহোক, আমি তাঁর এ মনোভাব দেখে নিরুৎসাহিত হই এবং অস্বস্তি বোধ করি।

সূত্র: এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক, মাওলা ব্রাদার্স, ২০০০

মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীরবিক্রম: প্রয়াত সেনাকর্মকর্তা; ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা