বিজয়ের প্রথম সূর্যোদয়

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। অন্যান্য শীতের ভোরের মতো সেদিনও সূর্য উঠছিল গাঢ় কুয়াশা ভেদ করে। কিন্তু অতি স্বাভাবিক এই প্রাকৃতিক দৃশ্যটাই যেন প্রতীকী হয়ে উঠেছিল। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটতে যাচ্ছিল সেদিন। এই ভূখণ্ডের মানুষের নিজের ভাগ্য নিজের হাতে তুলে নেওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা ইতিহাসে মাথাচাড়া দিয়ে বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেই দিনটি আসছিল তার অর্গলমুক্তির ক্ষণ হয়ে। জেগে উঠেছিল এক নতুন দেশের উদয়ের সূর্য, যে দেশের নাম বাংলাদেশ। বাঙালির এর আগের ২৬৬টি রুদ্ধশ্বাস দিন কেটেছে ঠিক এই দিনটিরই প্রতীক্ষায় কাতর হয়ে। 

উল্লাসের রক্তিমাভা সূর্য উঠেছিল ভারতের সেনাশিবিরেও। এই দিন সকাল নয়টায় যৌথবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজির একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পৌঁছায়। তিনি তাতে আগের দিন থেকে ঢাকায় বোমাবর্ষণ স্থগিত রাখার সময়সীমা বেলা তিনটা পর্যন্ত বাড়াতে অনুরোধ করেন। চূড়ান্ত করতে বলেন যুদ্ধবিরতির শর্তগুলোও। কার্যত ডিসেম্বরের শুরু থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ধারাবাহিক আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী তত দিনে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ তখন আর তাদের হাতের মুঠোয় নেই। ঢাকাতেও চলছে গেরিলাদের চোরাগোপ্তা হামলা। ভারতীয় বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল স্যাম মানেকশ সকাল সোয়া নয়টায় ফোন করেন মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবকে। জ্যাকব ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের অপর শীর্ষ সেনাকর্তা। জ্যাকবের কাছে নির্দেশ এল, দ্রুত ঢাকায় গিয়ে সেদিনই পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সব ব্যবস্থা করে ফেলতে।
পাকিস্তানি শিবিরে সেদিন যে সূর্য উঠেছিল, তার রং ছিল ঘনঘোর কালো। যেন দিন নয়, নেমে এসেছে আরও গাঢ়তর অবিশ্বাস্য কোনো রাত। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই সূর্য ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে আসছিল তাদের কাছে। ১৪ ডিসেম্বর থেকে শুধু নিয়াজি নন, পাকিস্তানের সামরিক শাসনকর্তারাও কার্যত পরাজয় মেনে নিতে শুরু করেছিলেন। এই দিন বেলা দেড়টায় ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এ এম মালিক ও নিয়াজিকে একটি বার্তা পাঠান:
এখন আপনারা এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছেন, যেখানে কোনো মানুষের পক্ষে আর লড়াই করা সম্ভব নয়। করে কোনো ফায়দাও নেই। এতে শুধু আরও মানুষের প্রাণ যাবে আর ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে। এখন যুদ্ধ থামাতে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঠানো সৈন্য ও বিশ্বস্ত সহযোগীদের প্রাণ বাঁচাতে যা যা করা দরকার, সব আপনি করুন।
এই বার্তা পেয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য উদ্বিগ্ন গভর্নর বারবার ফোন করতে থাকেন। কিন্তু আপাদমস্তক ধ্বস্ত ইয়াহিয়া তখন আমুণ্ডু আশ্রয় নিয়েছেন পানপাত্রে। প্রাদেশিক সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন বেসামরিক কর্মকর্তা হিসেবে সে সময় ঢাকায় কাজ করছেন হাসান জহির। ‘সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান: দ্য রাইজ অ্যান্ড রিয়েলাইজেশন অব বেঙ্গলি মুসলিম ন্যাশনালিজম’ বইয়ে তিনি লিখছেন:
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রেসিডেন্ট [ইয়াহিয়া খান] ঢাকায় তাঁর প্রতিনিধির সঙ্গে একটিবারের জন্যও কথা বলেননি। [১৪ ডিসেম্বর] বিকেলে গভর্নর পদত্যাগ করলেন। তিনি আর তাঁর মুখ্য সচিব আশ্রয় নিলেন হোটেলে। আমাদের বলা হলো যে রাও ফরমান আলী সেনানিবাসে ঠাঁই নিয়েছেন। ২৪ বছর বয়সী পূর্ব পাকিস্তান সরকার এভাবে বিলুপ্ত হলো।
হাসান জহির মিথ্যা বলেননি। পাকিস্তানের তরফ থেকে ১৪ ডিসেম্বরই আসলে সব শেষ হয়ে যায়। বাকি ছিল কেবল পরাজয় মেনে নেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা। বার্তাটি পেয়ে নিয়াজিও বসে থাকেননি। মানেকশকে পাঠানোর জন্য একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব লেখা হলো। কিন্তু ভারতীয় বিমান-হামলায় বেতার-যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। নিয়াজি তাই সেটি তুলে দিলেন ঢাকার মার্কিন কনসাল-জেনারেল স্পিভাকের হাতে। মানেকশর কাছে এ প্রস্তাব পৌঁছে গেলেই যুদ্ধের অবসান ঘটে যেতে পারত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে রক্ষার একটি শেষ উপায় খুঁজে বের করার মরিয়া চেষ্টা চালায়। প্রাপকের কাছে সে বার্তা এ কারণে পৌঁছায় ২১ ঘণ্টা পরে। এই বিলম্ব বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের এক বিরাট অবকাশ এনে দেয়।
কিন্তু বাঙালির বিজয়ের সুবাস ১৪ ডিসেম্বরের পর থেকেই নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। লেখা শুরু হয়ে গেছে বাঙালির বিজয়কাণ্ড।
মানেকশর বার্তা পেয়ে হেলিকপ্টারে ঢাকার পথে উড়াল দিয়েছেন জ্যাকব। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ঊর্ধ্বতন ভারতীয় সেনাকর্তারা। বাংলাদেশের পক্ষে আছেন মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার। থাকার কথা ছিল মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানীরও। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তিনি ততক্ষণে চলে গেছেন সিলেটের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনে। তাঁরা যখন তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে নামলেন, তখন সেখানে গিজগিজে ভিড়। ভেতরে সাংবাদিকদের অসম্ভব জটলা। বাইরেটা ঘিরে রেখেছে জনতার ঢল।
জ্যাকবকে নিয়াজি তাঁর অফিসে স্বাগত জানান। ঠিক হয়, আত্মসমর্পণপর্ব অনুষ্ঠিত হবে রেসকোর্স ময়দানে, জনতার সামনে। প্রথমেই অরোরাকে দেওয়া হবে গার্ড অব অনার। এরপর দলিলে দস্তখত পর্ব। সবশেষে নিয়াজি সমর্পণ করবেন তাঁর তরবারি। কিন্তু নিয়াজি জানালেন, তাঁর তো তরবারি নেই। ঠিক হলো, নিয়াজি একটি রিভলভারই তুলে দেবেন তরবারির বদলে। প্রতীকী অর্থে। তবে জ্যাকব জানাচ্ছেন, যে রিভলভারটি নিয়াজি পরে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন, সেটি সম্ভবত তাঁর নিজের ছিল না। ছিল সাধারণ কোনো সৈনিকের। রিভলভারটি ছিল অতি নোংরা। সেটির নল ছিল ময়লা দিয়ে বুজে যাওয়া।
ঢাকার রাজপথে তখন অন্য দৃশ্য। নয় মাসের নারকীয় গুমোট থেকে হঠাৎ মুক্তি পেয়েছে শহরটি। বিজয়ের ঘ্রাণ পেয়ে ঢাকার দিকে আসতে শুরু করেছেন ঝাঁকে ঝাঁকে মুক্তিযোদ্ধা। ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন হাজার হাজার উচ্ছ্বসিক মানুষও। পথে পথে তাঁরা ঘিরে ধরছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। হাত মেলাচ্ছেন। বহু বছর পর হঠাৎ খুঁজে পাওয়া সহোদরের মতো বুকে জড়িয়ে ধরছেন। মুহুর্মুহু উল্লাসে ফেটে পড়ছেন সবাই। এক অপার্থিব আনন্দ তাঁদের চোখেমুখে।
রেসকোর্স ময়দান। যথারীতি গার্ড অব অনার হলো। অরোরা আর নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে দস্তখত করলেন। দস্তখতের জন্য অরোরা গাঢ় কালো কালির একটি শেফার কলম কিনে এনেছিলেন। কিন্তু নিয়াজি সই করার সময় কালি বেরোল না। কলমটিতে ঝাঁকি দিয়ে কালি ঠিক করা হলো। তারপর স্বাক্ষর। স্বাক্ষর করার সময়, খুব সচেতনভাবে বা বেখেয়ালে, প্রথমে পুরো নামটি নিয়াজি লিখলেন না। তিনি স্বাক্ষর করলেন, ‘এ এ কে নিয়া’। সেটি নজরে পড়ল ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা এন কৃষ্ণনের। এবার নামটি পুরো করে লিখলেন নিয়াজি।
আত্মসমর্পণের দলিলে এর সময় লেখা ছিল ‘১৬৩১ ঘণ্টা (ভারতীয় সময়) ’। কিন্তু জ্যাকব লিখেছেন, তাঁর ঘড়িতে তখন চারটা বেজে পঞ্চান্ন। স্বাক্ষরের পর কাঁধ থেকে অধিনায়কের ব্যাজ খুলে রাখলেন নিয়াজি। .৩৮ রিভলভার তুলে দিলেন অরোরার হাতে। তাঁর চোখে অশ্রু—পরাজয়ের, লজ্জার, আত্মকরুণার। শীতের সংক্ষিপ্ত দিনের পর ঘন হয়ে নামতে শুরু করেছে সন্ধ্যা। একটু পরের যে সূর্যাস্ত, তার সঙ্গে একটি ইতিহাসের যবনিকা পতন হবে।
পাকিস্তানের এককালের লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সেই রাতে, ইতিহাসের সেই সমাপনী পর্বে, তাঁর রোজনামচায় লিখলেন:
বেদনাদায়ক হলেও বাংলার এই বিভাজন ছিল অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য। ওই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা এই কুহকী বিশ্বাসে মজে ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের শত্রু। ভালো হতো যদি আমাদের শাসকেরা সময়মতো এটা উপলব্ধি করে ভারতের হাতে এর অস্ত্রোপচারের দায়িত্ব না দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বাঙালিদের চলে যেতে দিত।
এই কথায় ঘৃণা, হতাশা ও আক্ষেপ ছিল; কিন্তু বিন্দুমাত্র উপলব্ধি ছিল না। কারণ সে পথে হাঁটার সুযোগ আইয়ুবও পেয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছিলেন। কিন্তু সে পথে নিজেও হাঁটেননি। অবশেষে যুদ্ধ করে বুকের রক্ত ঢেলেই এ বিজয় ছিনিয়ে আনতে হলো বাঙালিকে।
এবার বহুদিন পর নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গেল বাংলাদেশের মানুষ। পরদিন ইতিহাসের আরেক ভোর। সেদিন থেকে শুরু হবে নিজের দেশের মাটিতে পা ফেলে তাঁদের নিজেদের পথচলা।