বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪১ শতাংশ অব্যবহৃত: সিপিডি

ফাইল ছবি

বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪১ শতাংশ অব্যবহৃত: সিপিডগত বছর সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময়ও ৪১ শতাংশ বিদ্যুৎ অব্যবহৃত ছিল। চাহিদা প্রক্ষেপণে দুর্বলতার কারণে বিদ্যুৎ খাত ও অর্থনীতি দুটিই নানা সমস্যার মধ্যে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়ে এখন বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। এসব আমদানির জন্য অনেক অর্থ বিদেশে গেছে, নানা রকম খরচ বেড়েছে।
‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা: বিশ্লেষণাত্মক কাঠামো, পদ্ধতি ও প্রভাবিত করার নিয়ামক পরিপ্রেক্ষিত’ নিয়ে গবেষণা নিবন্ধে এসব কথা জানায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

বৃহস্পতিবার অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এ নিবন্ধন উপস্থাপন করা হয়। এতে অংশ নিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মহাপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে অতিরিক্ত চাহিদার প্রক্ষেপণই বিদ্যুৎ খাতে নেওয়া মহাপরিকল্পনার বড় দুর্বলতা। এর ফলে অতিরিক্ত উৎপাদনক্ষমতা তৈরি হচ্ছে এবং এতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান বাড়ছে। সারা দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ না করে শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে হিসাব করলে হবে না। নগরায়ণ, শিল্প খাতের বিকাশ মূল্যায়ন করে বিদ্যুতের চাহিদা হিসাব করতে হবে।

শেষে সবার আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্চালক, সিপিডির প্রধান গবেষক ও বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নতুন মহাপরিকল্পনায় চাহিদার প্রক্ষেপণ সঠিকভাবে করতে হবে। বিদেশিদের সহায়তা নেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক বিজ্ঞানীদের যুক্ত করা জরুরি। বাণিজ্যিক স্বার্থ নয়, জাতীয় ও ভোক্তা স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এ দায়িত্ব সরকারের।

জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, ২০৪১ সালের রূপকল্প অনুসারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং সবার জন্য জ্বালানি নিশ্চিত করার বিষয় তিনটি বিবেচনায় নিয়েই মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।

আলোচনায় বক্তারা বলেন, সক্ষমতা বাড়িয়ে বাপেক্সের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে। এ খাতে সরকারের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবহেলা দূর করা দরকার। দেশের গ্যাস উত্তোলনে জোর দিয়ে বিদেশনির্ভরতা কমানো জরুরি হয়ে পড়েছে। পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানিসাশ্রয়ী পরিকল্পনা নিতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানো দরকার। ২০৪১ সালের লক্ষ্যমাত্রা অবশ্যই থাকবে কিন্তু অর্থনৈতিক চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ৫ থেকে ১০ বছরের পরিকল্পনা নিলে তা বেশি কার্যকর হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ম. তামিম বলেন, ২০১০ সালে করা প্রথম মহাপরিকল্পনার ৬০ শতাংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাস্তবিক পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। দীর্ঘ মেয়াদে নেওয়া পরিকল্পনায় ভুল মূল্যায়নের কারণে চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি নিয়ে পূর্বাভাস মেলেনি। তাই স্বল্প মেয়াদে পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, বিশ্ব এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশের সরকার সারা দুনিয়ার পরিত্যক্ত পারমাণবিক ও কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদনে যাচ্ছে। তারা জাতীয় স্বার্থ দেখে না। সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বহুজাতিক কোম্পানি, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতের লবিস্টরা প্রভাব বিস্তার করে। নাগরিকদের মতামত সেখানে উপেক্ষিত হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, শূন্য কার্বন নিঃসরণে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়েই এগোনো হচ্ছে। এর ভিত্তিতেই স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে মহাপরিকল্পনা তৈরি করবে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সি জাইকা।

সেমিনারে নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। এতে বলা হয়, জিডিপিতে বছরে বিদ্যুৎ খাতের অবদান বেড়েছে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্য যেকোনো খাতের চেয়ে এটি অনেক বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির মিশ্রণ নিয়েও বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়।

সিপিডির নিবন্ধে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। নতুন করে মহাপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে এতে বলা হয়, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিতে হবে। কয়লার পরিবর্তে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক (এলএনজি) বিদ্যুৎকেন্দ্র না করে নবায়নযোগ্য উৎপাদনে যেতে হবে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে আরও বক্তব্য দেন বুয়েটের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন, বাংলাদেশে জাইকার প্রধান প্রতিনিধি ইউহো হায়াকাওয়া, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান করিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা প্রমুখ।

সিপিডি জানায়, বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান মহাপরিকল্পনা করা হয় ২০১৬ সালে, এটি করে জাইকা। ২০১৮ সালে এটি এক দফা সংশোধন করা হয়। নতুন করে মহাপরিকল্পনার খসড়া তৈরি করতে ইতিমধ্যেই জাইকার সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।