বিপাকে দরিদ্ররা, মধ্যবিত্তও চাপে

চাল
ফাইল ছবি

মোটা চালের দাম যেন সুতাছেঁড়া ঘুড়িতে পরিণত হয়েছে। কত উঁচুতে উঠবে, কোথায় গিয়ে নামবে, তা কেউ ধারণা করতে পারছে না। শুধু মোটা নয়, সরু ও মাঝারি চালের দাম এখন মগডালে।

দরিদ্র মানুষের নিত্যদিনের বাজারের তালিকায় থাকে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ ও আলু। এখন ডাল ছাড়া বাকি সব কটির দামই বাড়তি। শুধু বাড়তি বললে ভুল হবে, দাম অস্বাভাবিক উচ্চতায় উঠে গেছে।

যেমন মোটা চালের দাম এখন তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দুই মাসে অনেকটা লাফিয়ে বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। পেঁয়াজ শতক হাঁকিয়েছে। আলুর দাম এত বেশি কখনো ছিল কি না, তা মনে করতে পারছেন না পুরোনো ব্যবসায়ীরা। বিপরীতে করোনাকালে মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। নতুন করে দেড় কোটির মতো মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে।

দরিদ্র মানুষের দৈনিক আয়ের বড় অংশ খরচ হয় চাল কিনতে। সরু ও মাঝারি চালের মূল ভোক্তা মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্তরা। সবাই চাপে রয়েছেন।

অবশ্য কৃষি মন্ত্রণালয় এখনো মনে করছে, চালের দাম নিয়ন্ত্রণেই আছে। কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, মূলত মোটা চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। অন্য চালের দাম ঠিক আছে। করোনা ও বন্যার কারণে দরিদ্রদের মধ্যে ত্রাণসহায়তা বেশি দেওয়ায় মোটা চালের দাম বাড়তি উল্লেখ করে মন্ত্রী আরও বলেন, সরকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। দাম আরও বাড়লে আমদানি করে বাজারে সরবরাহ বাড়ানো হবে।

কৌশলে কাজ হয়নি

বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মন্ত্রণালয় গত ২৯ সেপ্টেম্বর মিলমালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে সরু মিনিকেট চাল মিলগেটে সাড়ে ৫১ টাকা ও মাঝারি চাল ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। তখন কুষ্টিয়ার মোকামে সরু মিনিকেট চাল ৫৩ টাকা ও মাঝারি চাল ৪৬ থেকে ৪৭ টাকা ছিল। মোটা চালের দাম নির্ধারণ করা হয়নি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, মিল থেকে মোটা চালের সরবরাহ নেই।

দাম নির্ধারণের প্রভাব বাজারে পড়েনি। উল্টো বেড়ে গেছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক সপ্তাহে সরু চালের দাম কেজিতে এক টাকা বেড়েছে।

বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার খুচরায় প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, মাঝারি চাল ৫২ থেকে ৫৫ টাকা এবং সরু মিনিকেট চাল ৫৮ থেকে ৬২ টাকায় বিক্রি হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই দাম তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৭ সালের এই সময়ে মোটা চাল ৫০ টাকা কেজিতে উঠেছিল। ওই বছর হাওরে ফসল নষ্ট হয়েছিল।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ঢাকায় গত সোমবার তিন ধরনের মোটা চালের দাম ৫১ থেকে ৫৫ টাকা ছিল। ক্যাব বলছে, ২০০০ সালে একই চাল প্রতি কেজি ১৫ থেকে ১৭ টাকা ছিল।

বেসরকারি চাকরিজীবী শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘৫০ কেজির এক বস্তা চাল কিনতে এখন তিন হাজার টাকা লাগে। সবজি না হয় বন্যায় নষ্ট হয়েছে, চালের বাজারে কী?’

নতুন কর্মসূচি নেই

খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তাদের গুদামে যথেষ্ট পরিমাণে চাল রয়েছে। বর্তমান মজুত ৯ লাখের টনের বেশি। আগামী ডিসেম্বরে আমন ধান কাটা শুরু হবে। তখন বাজারে চালের দাম কমবে।

খাদ্যসচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যা মজুত আছে, তা দিয়ে এ বছরের চাহিদা মিটবে। আর খোলাবাজার ও সামাজিক নিরাপত্তায় আমরা যথেষ্ট চাল দিচ্ছি। চাহিদা বাড়লে অবশ্যই তা বাড়ানো হবে।’

সাধারণত মোটা চালের দাম প্রতি কেজি ৪০ টাকা ছাড়ালেই সরকার খোলাবাজারে চাল বিক্রি বাড়িয়ে দেয়। এ বছর মোটা চালের কেজি ৫০ টাকায় উঠেছে। এ ছাড়া নতুন দরিদ্র বেড়েছে। কিন্তু সরকারের কোনো বাড়তি কর্মসূচি নেই।

প্রতিবছর সেপ্টেম্বর থেকে সরকার ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা দরে মাসে ৩০ কেজি চাল দেয়। সেটি শুরু হয়েছে। কিন্তু এর আওতায় বিপুলসংখ্যক নতুন দরিদ্র নেই।

ঢাকাসহ বড় শহরে ট্রাকে করে খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল বিক্রির কোনো পরিকল্পনা খাদ্য অধিদপ্তরের নেই। রাজধানীতে ১২০টি দোকানে ৩০ টাকা কেজি দরে ওএমএসের চাল বিক্রি হচ্ছে। যদিও প্রতিদিন সব দোকানে চাল বিক্রি হয় না। প্রতিদিন সাকল্যে ৫০ থেকে ৬০ জন ডিলার চাল বিক্রি করেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে গরিবদের জন্য ওএমএসের চাল বিক্রি বাড়ানো সরকারের দায়িত্ব। করোনা, বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে যে ক্ষতি হয়ে গেল, তা পোষাতে গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য বিশেষ সহায়তা দেওয়া দরকার।

আমন পিছিয়েছে

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আমন নিয়ে এবার বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এ বছর আমন আবাদের যে লক্ষ্য (প্রায় ৫৬ লাখ হেক্টর জমি) ঠিক করা হয়েছিল, তা অর্জিত হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বন্যার কারণে এবার দেশের উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত ২৫টি জেলায় আমন আবাদে এক মাসের মতো দেরি হয়েছে। সাধারণত দেরি হলে ফলন কিছুটা কম হয়। এ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ধান-চাল মজুতের প্রবণতা রয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী মনে করেন, ‘সরকারি গুদামে কত চাল আছে, দেশে মোট কী পরিমাণ উৎপাদিত হয়েছে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাজারে চাল আছে কি না।’ তিনি প্রথম আলোকে বলেন বলেন, মোটা চালের দাম যদি ৫০ টাকা কেজি হয়, সেটা অবশ্যই বিপুলসংখ্যক গরিব মানুষের জন্য বিপজ্জনক খবর। এ ক্ষেত্রে দাম বেঁধে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। প্রয়োজন সরবরাহ বাড়ানো।