বিশাল সমুদ্রে প্রথম বৈসাবি

শিশুটি এসেছে বিশাল বঙ্গোপসাগরে ফুল বিসর্জন দিয়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসব পালনে। আজ যে তাদের বৈসাবি উৎসবছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের শৈবাল পয়েন্ট। আজ সোমবার সকাল ছয়টা। সৈকতের নির্জন বালুচর। এর মধ্যে লাল ও সাদা রঙের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সৈকতে নামছে আট বছর বয়সী এক চাকমা শিশু। তার দুই হাতে ফুলের পাপড়ি, মাথায় ফুলের মালা, গলায় ঐতিহ্যবাহী রুপার সাদা গয়না।
শিশুটি এসেছে বিশাল বঙ্গোপসাগরে ফুল বিসর্জন দিয়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসব পালনে। আজ যে তাদের বৈসাবি উৎসব।

শিশুটির নাম অপ্সরা চাকমা। সে পড়ছে কক্সবাজার হলিচাইল্ড স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। তার বাড়ি খাগড়াছড়িতে। অপ্সরার পেছন পেছন সৈকতে নামেন তার বাবা সোলেন চাকমা, পাঁচ বছর বয়সী ছোট ভাই মহৎ চাকমা, মা নিতা চাকমা।

সোলেন চাকমা চাকরি করছেন কক্সবাজার বায়তুশশরফ চক্ষু হাসপাতালে আইটি অফিসার পদে। আর মা নিতা চাকমা কক্সবাজার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের নার্স। তাঁদের হাতেও ফুল। পরনে ঐতিহ্যবাহী পোশাক।

করোনার সংক্রমণ রোধে জেলা প্রশাসন ১ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১৪ দিনের জন্য সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের সমাগম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

সোলেন চাকমা ( ৪০) বললেন, ‘চাকরির সুবাদে পরিবার নিয়ে কক্সবাজার শহরে থাকছেন। করোনাকাল চলছে, চলছে লকডাউন। ১৪ এপ্রিল থেকে নাকি আসছে আরও কঠোর লকডাউন। সবকিছু বিবেচনা করে এবার বৈসাবি উৎসব পালনে বাড়িতে যাওয়া হয়নি। কিন্তু আনন্দ তো আর আটকে রাখা যায় না। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছুটে এলাম বঙ্গোপসাগরের এই নির্জন সৈকতে। সমুদ্রের শান্ত লোনাজলে ফুল বিসর্জন দিয়ে জীবনের প্রথম বৈসাবি উদ্‌যাপন করলাম। সীমিত আকারে হলেও এটা সারা জীবন মনে থাকবে।’

শুধু এই পরিবারই নয়, নববর্ষকে বরণ করতে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান এলাকার বেশ কয়েকজন আদিবাসী জনগোষ্ঠী আজ সকালে সৈকতে নামেন বৈসাবি উৎসব পালনে।


করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই ১২ এপ্রিল থেকে পাহাড়ের প্রধান উৎসব বৈসাবি শুরু হয়েছে। করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় এবারও গতবারের মতো উৎসব সীমিত করা হয়। তিন পার্বত্য জেলাতেই উন্মুক্ত স্থানে এবারও কোনো আয়োজন হচ্ছে না।

‘বৈসাবি’ নামকরণ পাহাড়ি তিনটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের (ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা) বর্ষবরণ উৎসবের প্রথম অক্ষর দিয়ে। ‘বৈ’ শব্দাংশটি ত্রিপুরাদের বৈসু থেকে, ‘সা’ শব্দাংশটি মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং ‘বি’ শব্দাংশটি চাকমাদের বিজু থেকে এসেছে।


বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু—এই তিন নামের আদ্যক্ষর নিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি। পুরোনো বছরের কালিমা আর জরাজীর্ণতা ধুয়েমুছে নতুন বছরকে বরণ করে নিতেই উৎসবের আয়োজন।

তবে কক্সবাজার সৈকতে আগে কখনোই বৈসাবি উৎসব পালিত হয়নি। বৈসাবির এ সময়ে সমুদ্রে ফুল দিতেও কাউকে দেখা যায়নি। কক্সবাজার শহরের বসবাসকারী রাখাইন সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসব সাংগ্রাই শুরু হয় ১৭ এপ্রিল থেকে। শহরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৩৩টি মণ্ডপে চলে জলে ভেঁজা সাংগ্রাই, অর্থাৎ জলকেলি উৎসব। রাখাইন তরুণ-তরুণীরা একে অপরের প্রতি জল ছুড়ে উল্লাস করেন।

রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মংছে হ্লা প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সংক্রমণ রোধে এবারও ১৭ এপ্রিল থেকে তিন দিনব্যাপী রাখাইন সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসব ‘সাংগ্রাই’ অথবা জলকেলি উৎসব হচ্ছে না। তবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে বৌদ্ধ বিহারে ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং ঘরে ঘরে খাবার বিতরণ ও আপ্যায়ন চলবে।

মংছে হ্লা বলেন, কক্সবাজার সৈকতে আগে কখনোই বৈসাবি উৎসব পালিত হয়নি। করোনা উপলক্ষে শহরে বসবাসরত চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন সৈকতে নেমে ফুল দিয়ে তাঁদের বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি পালন করছে। বৈসারি উৎসবে রাখাইন সম্প্রদায়ের কারও অংশগ্রহণ থাকে না।

পুরোনো বছরের কালিমা আর জরাজীর্ণতা ধুয়েমুছে নতুন বছরকে বরণ করে নিতেই বৈসাবির আয়োজন
ছবি: প্রথম আলো

দেখা গেছে, সকাল ছয়টা থেকে সৈকতের ঝাউবাগানের ভেতরে কবিতা চত্বরে জড়ো হতে থাকেন চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের কিছু নারী, পুরুষ ও শিশু। সবার হাতে ফুল।
সকাল সাতটার দিকে পাঁচ মাসের শিশুসন্তান ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বৈসাবির ফুল দিতে সৈকতে নামেন খাগড়াছড়ির মেচকো চাকমা। তিনি সপরিবার থাকেন শহরের বৈদ্যঘোণা এলাকায় ভাড়া বাসায়। তাঁদের পেছন পেছন সমুদ্রে নামেন বান্দরবানের দুই তরুণ-তরুণী মিশন চাকমা ও ত্রয়া চাকমা। তাঁদের হাতেও ফুলের পাপড়ি, গলা ও মাথায় গোলাপ আর জবা ফুলের মালা।

বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু—এই তিন নামের আদ্যক্ষর নিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি। পুরোনো বছরের কালিমা আর জরাজীর্ণতা ধুয়েমুছে নতুন বছরকে বরণ করে নিতেই উৎসবের আয়োজন।

কয়েকজন চাকমা ও মারমা তরুণ-তরুণী জানান, গত বছর খাগড়াছড়িতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বর্ষ বিদায় ও বরণের উৎসব বৈসাবি উদ্‌যাপন করেছেন। কিন্তু করোনার জন্য এবার বাড়ি যাননি। কারণ, উৎসব–আনন্দের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। বেঁচে থাকলে এ রকম উৎসব–আনন্দ অনেক করা যাবে। তারপরও উৎসব তো উৎসবই। উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে সীমিত আকারে এবং স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে ছুটে আসা। ফাঁকা সৈকতে সীমিত আকারে হলেও উৎসব হয়েছে, আনন্দের ঢেউ ছিল বিশাল, যা সারা জীবন মনে থাকবে।

করোনার সংক্রমণ রোধে জেলা প্রশাসন ১ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১৪ দিনের জন্য সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের সমাগম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পর্যটক না থাকায় সৈকত এলাকার পাঁচ শতাধিক হোটেল–মোটেল, গেস্টহাউস ও কটেজ খালি পড়ে আছে।