বিশেষ সুযোগ রেখেই বাল্য বিবাহ নিরোধ বিল পাস

বিভিন্ন মহলের আপত্তির মুখে বিশেষ প্রেক্ষাপটে কম বয়সে ছেলেমেয়েদের বিয়ের বিধান রেখে বাল্যবিবাহ নিরোধ বিল ২০১৭ গতকাল সোমবার সংসদে পাস হয়েছে। বিলের ওপর বিরোধীদলীয় সদস্যের দেওয়া জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও সংশোধনী প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ বিলটি পাসের জন্য উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।

বিল-সম্পর্কিত নোটিশের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সাংসদ ফখরুল ইমাম বলেন, সংবিধানে বলা আছে কারও বয়স ১৮ হলে তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হবেন। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা ভোটার। ১৮ বছরের আগে কেউ ভোটার হতে পারেন না। সুতরাং এই আইনে প্রাপ্তবয়স্কের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়।

ফখরুল ইমাম প্রাপ্তবয়স্কের সংজ্ঞার বিষয়ে প্রতিমন্ত্রীর কাছে ব্যাখ্যা দাবি করেন। একই দলের সেলিম উদ্দিন এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। তবে প্রতিমন্ত্রী এ প্রশ্নের কোনো ব্যাখ্যা দেননি।

এই বিল পাসের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশেষ বিধান বাতিলে আমরা অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশেষ বিধান বহাল থাকছেই। এই বিধান কোনোভাবেই বাল্যবিবাহ নিরোধে সহায়ক হবে না।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, ‘আইনে বিশেষ বিধান রেখে বিল পাস করায় অামরা খুব অবাক হইনি। তবে বিষয়টি খুবই লজ্জা ও দুর্ভাগ্যজনক।’

আলোচিত এই বিলটি গত ৮ ডিসেম্বর সংসদে উত্থাপিত হয়। পরে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। কমিটি বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বিশেষ বিধান শুধু মেয়েদের জন্য নয়, ছেলেদের জন্যও প্রযোজ্য করার প্রস্তাব করে। এর আগে মন্ত্রিসভা অনুমোদিত প্রস্তাবিত আইনে এই বিধান শুধু মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। সংসদীয় কমিটি ৯ ফেব্রুয়ারি বিলের প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করে।

মন্ত্রণালয়ের উত্থাপিত বিলের ১৯ দফায় বলা হয়েছে, এই আইনের অন্যান্য বিধানে যা কিছু থাকুক না কেন, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশক্রমে এবং মাতা-পিতার সম্মতিক্রমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিয়ে সম্পাদিত হলে তা এই আইনের অধীন অপরাধ বলে গণ্য হবে না।

এ ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটি ‘কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর’ শব্দগুচ্ছ বাদ দিয়ে ‘বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্কের’ এবং ‘মাতা-পিতা’ শব্দের পরিবর্তে ‘পিতা-মাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের’ শব্দগুচ্ছ যোগ করার সুপারিশ করে।

বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ বলেন, বাল্যবিবাহ সারা বিশ্বের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই সমস্যাটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বাল্যবিবাহ মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি বন্ধে একটি যুগোপযোগী আইন থাকা জরুরি। দেশের মানুষ বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানে, কিন্তু মানে না।

পাস হওয়া বিলে বলা হয়েছে, কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষ বাল্যবিবাহ করলে সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। বিলটি আইন হিসেবে কার্যকর হলে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট-১৯২৯’ বাতিল হয়ে যাবে।

 বাল্যবিবাহ নিরোধ-সংক্রান্ত বিলটি পাস হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, আইনে এই বিশেষ বিধান থাকায় শিশুদের সব সুযোগ নষ্ট করে দেওয়া হলো।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহিলা আইনজীবী সমিতি শেষ চেষ্টা হিসেবে এখন আদালতের আশ্রয় নেবে। অন্যান্য নারী ও শিশু সংগঠনগুলোও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবে এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বিষয়টি মোকাবিলা করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’ তিনি মনে করেন, এই আইনের অপব্যবহার বাড়বে এবং বাল্যবিবাহ ঠেকানো যাবে না।