বিশ্ব শিশু দিবসে আমাদের প্রত্যাশা

আজ ২০ নভেম্বর বিশ্ব শিশু দিবস। এই বিশেষ দিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিশুরা জানিয়েছে তাদের প্রত্যাশার কথা

একটি সুন্দর পৃিথবী গড়ে তুলতে শিশুদের কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে এবং তার ভিত্তিেত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে পদক্ষেপ
ছবি: ইউনিসেফ/ইউএনআই২৪৮৭১৭/মাওয়া

এ দেশে আমাদের সবার অধিকার সমান

স্বপন সরকার, বয়স ১৭, কুড়িগ্রাম

আমরা শিশুরা একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই; যেখানে জাত-পাত, ধর্ম ও বর্ণনির্বিশেষে সবাই শান্তিতে ও নিরাপদে থাকতে পারবে। আমরা এমন দেশ চাই, যেখানে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু জনগণের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকবে। কারণ, এ দেশ আমাদের সবার। বাংলার হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সব সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁদের প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে এবং এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যেই তাঁরা আত্মত্যাগ করেছিলেন। কোনো মহল যেন এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করতে না পারে, সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, এ দেশের প্রতি আমাদের সবার অধিকার যেমন সমান, তেমনি আমাদের দায়িত্বও সমান। আমরা সবাই একসঙ্গে শান্তিতে ও নিরাপদে থাকলেই প্রিয় স্বদেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিণত করতে পারব।

নারী উত্ত্যক্তকরণ বন্ধে চাই জোরালো পদক্ষেপ

নূশরাত ইসলাম, বয়স ১৫, বাগেরহাট

বাংলাদেশের অনেক মেয়ের জন্য যৌন হয়রানি একটা নিত্যদিনের সমস্যা। রাস্তায়-বাসে যাতায়াতের সময় মেয়েদের এর শিকার হতে হয়। শুধু এই কারণে অনেক মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা শিশুবিবাহের শিকার হওয়ার নজিরও এ দেশে আছে। এ কারণে অনেক অভিভাবক মেয়েদের দূরের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে চান না।

আমি কখনোই স্কুলে একা যাওয়া-আসা করিনি। শুধু আমার নিরাপত্তার জন্য আমার অভিভাবক সব সময় আমাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করেন। এই যৌন হয়রানি বন্ধের দায় কি শুধু মেয়েদের অভিভাবকদের? নিশ্চয়ই নয়। এটা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। যারা মেয়েদের এ ধরনের হয়রানি করে, তারাও তো কোনো না কোনো পরিবারের সন্তান। তার পরিবার যদি একজন মেয়ের অভিভাবকের মতো সচেতন হতো, যে আমার ছেলের দ্বারা যেন কোনো মেয়ে হয়রানির শিকার না হয়, তাহলে কি এটা পুরোপুরিভাবে বন্ধ হতো না? তাই নারী উত্ত্যক্তকরণ বন্ধে চাই জোরালো পদক্ষেপ।

পথশিশুদের অর্থবহ পুনর্বাসন

জাহাঙ্গীর আলম, বয়স ১৭, লালমনিরহাট

এ দেশের অনেক শিশুই শিক্ষা, পুষ্টিকর খাবার, বাসস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পথশিশুর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়। এ দেশে রয়েছে এমন লাখো পথশিশু, যারা করোনাভাইরাসের প্রকোপের সময়ও ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত।

যে বয়সে মা-বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে তাদের কেউ কেউ মহাসড়কে ফুল বিক্রি করে, কেউবা ফেরিওয়ালার কাজ করে, কেউ করে ভিক্ষা। শহরের নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে করতে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের নেই কোনো শৈশব, নেই কোনো স্বপ্ন, নেই কোনো উদ্যম কিংবা আশা। বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছে কেউ কেউ। মেয়ে পথশিশুরা প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনেরও শিকার হয়।

আজকের শিশুরাই আগামী দিনের সম্পদ। তাই এই বিরাটসংখ্যক শিশুকে বাদ দিয়ে জাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ কারণে এসব পথশিশুকে যথাযথ পুনর্বাসনের মাধ্যমে মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তাদের দুঃখ মোচন করে এক সম্ভাবনাময় ও দক্ষ প্রজন্ম এখনই গড়ে তুলতে হবে।

অভিভাবকদের পাশে চাই

আফ্রিদা জাহিন, বয়স ১৩, রংপুর

শৈশব পেরিয়ে আমরা কৈশোরে পা রেখেছি। একটু একটু করে বড় হচ্ছি, বড় হচ্ছে আমাদের গণ্ডি। নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শিখছি। সে স্বপ্ন পূরণে আমরা আমাদের অভিভাবকদের পাশে চাই। আমাদের সবারই স্বপ্ন থাকে। তবে সবাই কিন্তু তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারে না। এর অন্যতম কারণ হলো পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা। বিশেষ করে মেয়েরা এ সমস্যার সম্মুখীন হয় বেশি। মেয়েদের সবকিছুতেই যেন বাধা ডিঙাতে হয়। আমরা অনেকে অভিভাবকদের চাপে বাধ্য হয়ে নিজের স্বপ্নকে মেরে ফেলি। মা-বাবাকে খুশি করতে গিয়ে, কথিত সফলতার পেছনে ছুটতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাই। কিন্তু অনেক অভিভাবক সেই বিষয়টা বোঝেন না। তাঁরা সন্তানদের মতামত বা ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেন না। আপনারা আমাদের উৎসাহিত করুন। যেন আমরা নিজেদের প্রতিভাগুলো বিকাশের সুযোগ পাই এবং দেশ ও জাতিকে ভালো কিছু উপহার দিতে পারি।

ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা

আরিফিন মুন, বয়স ১৪, সিরাজগঞ্জ

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে পারিবারিক প্রয়োজনে অনেক শিশু কাজে যেতে বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুশ্রম আরও বেড়েছে। অভাব ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক মেয়ে শিশুবিবাহের শিকার হয়েছে। বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া রোধে অতীতে আমাদের অনেক সাফল্য আছে। তাই আমরা আশা করব, মহামারির কারণে ঝরে পড়া শিশুদের যত দ্রুত সম্ভব স্কুলে ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এই মহামারি অনেক শিশু-কিশোরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও পাঠ্যক্রমে পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য স্কুলগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

যুগোপযোগী দক্ষতার জন্য চাই মানসম্মত শিক্ষা

তাসনুভা মেহজাবীন, বয়স ১৪, খুলনা

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কখনোই ত্রুটিমুক্ত ছিল না। করোনাকালে স্কুল বন্ধের সময়টায় আমাদের শিক্ষার্থীদের বিস্তর ক্ষতি হয়েছে, শিক্ষাব্যবস্থা হয়েছে আরও এলোমেলো।

মহামারির কারণে পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য তাই বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি আমরা চাই মানসম্মত শিক্ষা, যা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা সৃষ্টিতে সহায়তা করবে। মানসম্মত ও কর্মমুখী শিক্ষাই পারবে আমাদের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করতে। এ কারণে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তা অনতিবিলম্বে করতে হবে। কারণ, মানহীন শিক্ষা আমাদের জাতীয় অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করবে।

তাই ২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় যেন ডিগ্রি প্রাপ্তির চেয়ে শেখার ওপরে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষাব্যবস্থা যেন এমন হয়, যেখানে গুণ ও দক্ষতা অর্জনেরও সুযোগ থাকে।

চাই পরিবেশবান্ধব শিক্ষা ও জীবনদক্ষতা

আসাদুজ্জামান, বয়স ১৬, ঠাকুরগাঁও

গত ২০ বছরে বিশ্বের যে ১০টি দেশ সবচেয়ে বেশি দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ নবম। এ সময়ে বাংলাদেশের ১১ কোটি ২০ লাখ মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছে। সিআরইডি ও জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউএনডিআরআর–এর যৌথ এক প্রতিবেদনে পাওয়া এই পরিসংখ্যান আমাকে এতটাই ভয় পাইয়ে দিয়েছে যে আমি মনে করি, এখনই রুখে না দাঁড়ালে এটি করোনা মহামারির চেয়েও ভয়ানক হয়ে হামলে পড়বে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, নদীভাঙন, খরা, দাবদাহ, শৈত্যপ্রবাহ—এসবই দুর্ভোগ হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়। আমার এলাকা উত্তরবঙ্গেও এখন খরা ও বন্যা বেড়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে অন্যায় করা হলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা বন উজাড় করছি, বন্য প্রাণী ধ্বংস করছি, নদী ভরাট করছি—প্রকৃতির কত শত অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে। আমরা এসব বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে চাই।