ডেঙ্গু দমন দলিল চাপা পড়ে আছে ২ বছর

ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিকল্পনা দলিল দুই বছর ধরে চাপা পড়ে আছে। এই সময়ে যেসব কাজ করার কথা ছিল, তার প্রায় কিছুই করা হয়নি। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ডেঙ্গুর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক ড. কে কৃষ্ণমূর্তি ২০১৭ সালে এই পরিকল্পনা তৈরি করেন। ২০১৯ সালের মধ্যেই তা বাস্তবায়নের কথা। এখন দেখা যাচ্ছে, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, ওই দলিলই অনেকে দেখেননি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট দপ্তরও এ ব্যাপারে পরিষ্কার করে কিছু বলছে না।

দুই দিন আগে ‘মিড–টার্ম প্ল্যান ফর কন্ট্রোলিং অ্যান্ড প্রিভেন্টিং এডিস–বর্ন ডেঙ্গু অ্যান্ড চিকুনগুনিয়া ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ২২ পৃষ্ঠার ওই পরিকল্পনা দলিল প্রথম আলোর কাছে এসেছে। পরিকল্পনায় রোগ ও মশার ওপর নজরদারি, রোগী ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত কীট ব্যবস্থাপনা, রোগের প্রকোপের সময় জরুরি করণীয়, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, আচরণ পরিবর্তন, যোগাযোগ এবং পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে। কিন্তু এই দলিল আলোর মুখ দেখেনি।

এ বছর গতকাল রোববার পর্যন্ত সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮৭ হাজার ৬০৫ জন রোগী সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে এত বেশিসংখ্যক রোগী এর আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। এবারই প্রথম ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। ইতিমধ্যে চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ছেড়েছে ৮৫ হাজার ৭৯৭ জন। গতকাল নতুন ভর্তি রোগী ছিল ৩৪২ জন। গত ১৮ বছরের মধ্যে এবার ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যাও সর্বোচ্চ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু সন্দেহে ২৩১টি মৃত্যুর তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে ১৩৬টি মৃত্যু পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানটি ৮১টি মৃত্যু ডেঙ্গুজনিত বলে নিশ্চিত করেছে।

>বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, ওই দলিলই অনেকে দেখেননি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও পরিষ্কার করে কিছু বলছে না।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দলিল দুই বছর ধরে চাপা পড়ে থাকার ঘটনাটিকে অত্যন্ত দুঃখজনক বলে বর্ণনা করেছেন কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই পরিকল্পনায় কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে এ বছর ডেঙ্গুর এত বড় প্রকোপ হয়তো এড়ানো যেত।

এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেওয়ার পরপরই পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলে আসছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার কর্মকর্তারা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তহমিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওই প্রতিবেদন আমাদের দেয়নি। শুনেছি আইইডিসিআরকে দিয়েছে।’

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়নি।’ তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক কৃষ্ণমূর্তি পরিকল্পনার বিষয়বস্তু একটি সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। সেই উপস্থাপনার বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে আইইডিসিআর কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। 

তবে এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঢাকা কার্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশা ধ্বংস ও রোগী ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরির কথা উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। মশা নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ নিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মশা বিশেষজ্ঞকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতার মশা মারার অভিজ্ঞতা নিয়েছেন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে। এখন জানা যাচ্ছে, মশা মারতে ও ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় কী করতে হবে, তা বিস্তারিত বলা আছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক কৃষ্ণমূর্তির মধ্যবর্তী পরিকল্পনায়। 

পরিকল্পনার পটভূমি

২০১৭ সালে ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২ হাজার ৭৬৯ জন মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়। মারা গিয়েছিল ৮ জন। তখন ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ে নিয়ন্ত্রণে পরামর্শ দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কৃষ্ণমূর্তিকে ঢাকায় পাঠায়। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে কৃষ্ণমূর্তি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করেন। 

এই পরিকল্পনা প্রণয়নের দুটি উদ্দেশ্য ছিল: ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা কমানো; দ্বিতীয়ত, ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমানো। ২০১৭ সালের শেষ দিকে এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়। পরবর্তী দুই বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের মধ্যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা ছিল। 

কী আছে পরিকল্পনায়

ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের বোঝা কত বড় এবং আক্রান্ত মানুষের ওপর এই দুটি রোগের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব মূল্যায়নের কথা পরিকল্পনায় বলা আছে। রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের কর্মসূচিগুলো মূল্যায়ন করার কথাও লেখা আছে। এর কোনো কিছুই করা হয়নি।

মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার কথা সাম্প্রতিক কালে খুব শোনা গেছে। এখন মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এসব বিস্তারিত আছে ওই পরিকল্পনায়। মশা ও লার্ভা কীভাবে জরিপ করতে হয়, তা–ও বলা আছে।

জরুরি পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পেশার লোকদের নিয়ে ‘র‌্যাপিড রেসপন্স টিম’ নামের একটি দল তৈরির কথা ওই পরিকল্পনায় বলা আছে। ওই দলে রোগতত্ত্ববিদ, কীটতত্ত্ববিদ, অণুজীববিজ্ঞানী, তথ্য–শিক্ষা–যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছিল। এ রকম দলে কোনো সাংবাদিক অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বলে শোনা যায়নি।

ওই পরিকল্পনায় মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে যুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের সঙ্গে স্থানীয় সরকার, কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সহ মোট ১২টি মন্ত্রণালয় বা সংস্থাকে যুক্ত করতে বলা হয়। কার কী কাজ হবে, তা–ও সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যাখ্যা করা আছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গতকাল রাতে বলা হয়, তারা এই প্রতিবেদন সম্পর্কে কিছু জানে না। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাটি সম্ভবত তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার আগে। তিনি প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতি সম্প্রতি এ রকম একটি পরিকল্পনা দলিলের কথা শুনছি। আমরা চেষ্টা করছি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তা পাওয়ার।’

বর্তমানে দেশে মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পরামর্শ দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল কার্যালয় সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে বিশেষজ্ঞরা এসেছেন। গতকাল তাঁদের সঙ্গে একটি পরামর্শ সভায় অংশ নেন কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী। সভা শেষে মঞ্জুর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭ সালে পরিকল্পনা দলিলটি কে কারা চেপে রেখেছিল, তার তদন্ত হওয়া জরুরি।