বিশ্বজিৎকে ভুলে গেছি, আবরার...

বুয়েটে শেরেবাংলা হলের এই কক্ষে থাকতেন আবরার ফাহাদ। ছবি: প্রথম আলো
বুয়েটে শেরেবাংলা হলের এই কক্ষে থাকতেন আবরার ফাহাদ। ছবি: প্রথম আলো

আবরার ফাহাদের বাবার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। নিজেকে সেই জায়গায় আপনি যদি কল্পনা করেন, তবে আমি নিশ্চিত আপনার হাত-পা কাঁপতে থাকবে। সম্ভবত ভয়ানক আশঙ্কা আর সীমাহীন শোকে আপনি বোবা হয়ে যাবেন। ছাত্ররাজনীতির নাম করে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ঘুষ–বাণিজ্যের খবরে আপনার গা হয়তো আগেই গুলিয়ে আসত; এবার আপনার সন্তানের নিরাপত্তার চিন্তা আপনার ঘুম কেড়ে নেবে।

শুধু দল করার নাম করে কিছু ছাত্র ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর যা চালিয়ে যাচ্ছে গত কয়েক দশক ধরে, তা সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া কঠিন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্জনের বাগান বিধ্বস্ত করছে এরা। এরা হয়তো জানেই না, মানুষ এদের কতটা অপছন্দ করে। একটার পর একটা অসুন্দর ঘটনার জন্ম দিয়ে এরা পার পেয়ে যায়। আর আমরা সাদা শার্টে কালো ব্যাজ পরে শহীদ মিনারে মৃতের জন্য শোক জানিয়ে বাসায় চলে আসি। পুরো এক রাত ঘুমানোর পর আমাদের আর কিছু মনে থাকে না। আমরা বিশ্বজিৎকে ভুলে গেছি, আবরার ফাহাদকে ভুলতেও এক সপ্তাহের বেশি লাগবে না।

বাংলাদেশে আজকাল সবচেয়ে ক্ষমতা কারা দেখিয়ে বেড়ায় আমরা সবাই জানি এবং সব বুঝিও। দেশে ছাত্ররাজনীতি দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় কতটা প্রয়োজন সে কথায় না গেলাম, কিন্তু উদ্দেশ্য আর লক্ষ্যের ধার না ধারি ভাব নিয়ে যারা রাজনীতির নামে দেশজুড়ে গুন্ডামি করছে, এরা কারা? ছাত্ররা সবাই মিলে আসলে একটা দল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অথবা শিক্ষা ব্যবস্থায় দাবি আদায়ের পাশাপাশি জন দুর্ভোগে এগিয়ে যেতে পারে তারা। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ধর্ষণ, টেন্ডারবাজি, দলবাজির। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় হলে যা হয় আরকি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ যখন নানা সুনাম অর্জন করে এগিয়ে যাচ্ছে তরতর করে, ঠিক সেই সময়ে সরকারি দলের সহযোগী কয়েকটি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মেতেছেন দুর্নীতি, ক্যাসিনো ব্যবসায়। নীতি–আদর্শের সামান্য কোনো বালাই যে এদের মধ্যে নেই, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামমুখর জীবনের নানা দিক নিয়ে এঁরা যদি সত্যি পড়াশোনা করতেন; আমার মনে হয় না এঁরা কোনো জঘন্য কিছু করতে পারতেন। ছাত্রলীগের নেতাদের ছাত্রদের সুযোগ-সুবিধা আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নেওয়ার কথা। কিন্তু কে হায় নগদ নারায়ণ ছেড়ে আদর্শের লড়াই করবে?

আবরার ফাহাদ নামটি ওঁর বাবা-মা রেখেছিলেন, এর অর্থ ন্যায়বান সিংহ। হয়তো তাঁরা ছেলেকে নিয়ে স্বপ্নও এমন দেখতেন। একদিন দেশের মানুষের জন্য সব শক্তি দিয়ে কাজ করবেন তাঁদের ছেলে। সেই ছেলেকে কয়েকজন মিলে হত্যা করেছেন। তিনি বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজেও ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন আবরার ফাহাদ। কিন্তু তাঁর খুব ইচ্ছা প্রকৌশলী হবেন। তাই মেডিকেলে কিছুদিন ক্লাস করার পর সেখান থেকে চলে আসেন; ভর্তি হন বুয়েটে। কিন্তু সেটা আর শেষ হলো না। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, আবরারকে গত রোববার রাতে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা।

মারধরের পর ছাত্রলীগের কয়েকজন বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে বের করে নিয়ে যাচ্ছেন। ছবি: সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে
মারধরের পর ছাত্রলীগের কয়েকজন বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে বের করে নিয়ে যাচ্ছেন। ছবি: সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে

পত্রিকা পড়ে জেনেছি, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক কিছু চুক্তি ও সমঝোতার সমালোচনা করে ফেসবুকে আবরারের স্ট্যাটাস এ হত্যার কারণ বলে বুয়েটের ক্যাম্পাসে আলোচনা ছিল। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। আবরারের সর্বশেষ স্ট্যাটাস ছিল শনিবার বিকেল ৫টা ৩২ মিনিটে। এর পরদিন রোববার রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের নিজ কক্ষ থেকে আবরারকে ডেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেন। এরপর রাতে হলে খবর ছড়ানো হয়, ‘শিবির’ সন্দেহে আবরারকে পেটানো হয়েছে। অথচ সংবাদমাধ্যমে এসেছে আবরারের পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সে যা–ই হোক, ভিন্নমত থাকলেই তাঁকে এভাবে পিটিয়ে মারা যায়? এই লাইসেন্স ছাত্রলীগের ওই নেতাদের কে দিয়েছে?

বুয়েট শিক্ষার্থীরা আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। এ দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, শুধু এই সাধারণ ছাত্ররা নন; আজকের কোনো অভিভাবকই চান না তাঁদের ছেলেমেয়ে রাজনীতির নামে এসব করুক। অথচ এ দেশেই রয়েছে ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় অতীত।

ভাবতেই কষ্ট লাগে, যে ছাত্রসংগঠনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেই ছাত্রসংগঠনের কর্মী, নেতা-নেত্রীদের এমন অমানবিক, অনৈতিক এবং লাঠি হাতে শিক্ষাঙ্গনে মারামারি করা। আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো কাজে ছাত্রলীগকে তেমন খুঁজে পাওয়া না গেলেও বারবার তাদের ন্যায্য আন্দোলনে হামলা চালিয়েছেন সংগঠনটির কর্মীরা। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের মতো আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করার অসংখ্য অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হকের ওপরই শুধু ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কয়েকবার হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।

কয়েক দিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজ থেকে কমিশন দাবি, টাকার বিনিময়ে কমিটিতে পদ দেওয়া, অবৈধভাবে ক্ষমতা প্রদর্শনসহ নানা অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। নতুন নেতৃত্ব আসার পরও থামেনি ছাত্রলীগ।

সবাইকে মনে রাখতে হবে, যাঁরা তরুণদের বিপথগামী করার মন্ত্র শিখিয়ে নিজেদের কার্য হাসিল করছেন, তাঁরা দেশের প্রকৃত বন্ধু নন, তিনি হতে পারেন কোনো বড় রাজনৈতিক দলের নেতা বা অন্য কিছু। আর যাঁরা ছাত্ররাজনীতি করেন, তাঁদের কয়জন বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, তিনি কী কারণে রাজনীতি করেন? তাঁরা যে ইতিহাসের কথা মুখে আওড়ান, তার কিছু কি নিজেরা ধারণ করেন? আজকের ছাত্রনেতারা হয়তো জানেন না, ইতিহাস কাউকেই ছাড় দেয় না। আজ তাঁরা যা করে যাচ্ছেন, তার ইতিহাস একদিন লেখা হবে। তখন তা আর ঢাকবে কে?

লেখক: কবি ও কলামিস্ট