বিশ্বে জরুরি আইন: করোনা আঘাতেই কি গণতন্ত্রের মৃত্যু

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে পৃথিবী এখন বিপর্যস্ত। এর আঘাতে এখন পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতির অন্তত ১২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র (আইটিসি)। দেশে দেশে অর্থনীতি বেহাল এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যম যখন ব্যস্ত সময় পার করছে, সে সময়ে গণতন্ত্রের বিপন্নতা মনোযোগ পাচ্ছে সামান্যই। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি গণতন্ত্রেরও একটা বড় বাঁক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। নাগরিক জীবনে এখন আগের মতো স্বাধীনতা নেই। জনজীবনের ওপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ সামাজিক সংগঠন, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক কার্যক্রমকে স্থগিত রাখা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। মানুষ নিজের ইচ্ছার চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জারি করা রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধকে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনপ্রণালিতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিষয়টি বৈধতা পাচ্ছে বিশ্বাসগতভাবে। এখন প্রাত্যহিক নাগরিক জীবন রাষ্ট্রীয় নজরদারির আওতাভুক্ত হওয়ার বিষয়টি বৈধতা পেয়েছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সমাজে যা সম্ভব ছিল না। আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের পর রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত গণমাধ্যমও আজ নানামুখী সংকটে হুমকির সম্মুখীন। ফলে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারছে না তারা।

জাতীয়তাবাদের ঝান্ডা উড়িয়ে রাষ্ট্র হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী। বিশ্বের অনেক দেশেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তির হাতে আরও বেশি ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যা রাষ্ট্রনায়কদের সুযোগ করে দিচ্ছে একনায়কতন্ত্র কায়েমের। এমন ঘটনা যেমন ইউরোপে ঘটছে তেমনি ঘটছে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকাসহ অন্যান্য অঞ্চলেও। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান গত এপ্রিলে গণমাধ্যমের ক্ষমতা সংকুচিত করার ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, কিছু গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ভাইরাসের চেয়েও ক্ষতিকর। পরে (১৩ এপ্রিল, ২০২০) তুরস্কের পার্লামেন্টে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারির বৈধতা দিয়ে একটি আইন পাস করা হয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের চাপে বর্তমান পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমও স্বাভাবিক সময়ের মতো স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

গত ৩০ মার্চে ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরির পার্লামেন্টে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবানকে জরুরি প্রয়োজনে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য তাকে কোনো ধরনের জবাবদিহি করতে হবে না। প্রয়োজনে সংবিধান স্থগিতসহ যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন। যা প্রকারান্তরে একনায়কতন্ত্রেরই রূপ। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পুরো ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করতে ভুল করেননি তিনি। ১৯৩৩ সালে হিটলারের ‘অ্যানাবলিং অ্যাক্ট’ পাসের পর ইউরোপে এটিই প্রথম একনায়কতন্ত্র কায়েমের আইন। ফলে নিন্দার ঝড় উঠেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নেও (ইইউ)।

হাঙ্গেরির পাশের দেশ পোল্যান্ডেও জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্কের। প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস দুদার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি নির্বাচন আয়োজন করতে চাচ্ছে মহামারির মধ্যেই। বিরোধী দলের দাবি, করোনা পরিস্থিতির পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে অর্থনৈতিক ব্যর্থতার দায়ে ক্ষমতা হারাতেন দুদা। অথচ করোনাকে কাজে লাগিয়ে প্রথম দফার ভোটে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পথে এগিয়ে গেছেন তিনি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধেও ২০৩৬ সাল পর্যন্ত নিজ ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য আইন পাশের অভিযোগ উঠেছে এ মহামারির শুরুতেই।

ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিলের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও গণতান্ত্রিক কাঠামো ভাঙার অভিযোগ উঠছে। করোনা পরিস্থিতির সুযোগে ‘মুসলিমবিরোধী’ প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগ মোদি সরকারের দিকে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ডেমোক্র্যাটদলীয় রাজ্যগুলোর প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের।

এ প্রবণতা শুধু হাঙ্গেরি, তুরস্ক, পোল্যান্ড, রাশিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রই নয় আজারবাইজান, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ইসরায়েল ও বুরুন্ডির মতো দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। দেশগুলোতে সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে জরুরি আইন প্রণয়ন, পার্লামেন্টের ক্ষমতা হ্রাস, শীর্ষ নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা, বিরোধীদের ধড়পাকড়, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার মতো চরম গণতন্ত্র পরিপন্থী কাজ করছে। এর প্রতিবাদে জনগণ রাস্তায় নেমে আসতে পারছে না। অর্থাৎ করোনা পরিস্থিতিই এসব দেশের সরকারকে এমন আইন জারির সুযোগ এনে দিয়েছে।

আজারবাইজানে প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ করোনার কারণে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছেন। বিরোধী দলগুলোর কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছেন। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই বিশেষ আইন প্রণয়ন করে প্রবল ক্ষমতার মালিক হয়েছেন। মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব পালনে অত্যন্ত কড়াকড়ি নির্দেশের পাশাপাশি প্রয়োজনে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে পার্লামেন্ট কর্তৃক বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তিনি গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে ডিক্রিও জারি করেছেন। কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন মহামারির সুযোগে দেশটির সব বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। সব বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদকে জেলে পুরছেন। ১৯৮৫ সাল থেকে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা সেন এখন একদলীয় শাসনের বৈধতা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এদিকে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে।

মহামারি মোকাবিলায় দেশে দেশে ব্যবহৃত ‘কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং অ্যাপস’গুলোতে ব্যক্তিস্বাধীনতার হস্তক্ষেপের বিষয়টি পড়ে যাচ্ছে আড়ালেই। সবচেয়ে নিরাপদ কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং অ্যাপসও ব্লু টুথ, বিভিন্ন এনক্রিপটেড ডেটা, চলাচলের রুটসহ ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহের প্রয়োজন হচ্ছে। এই তথ্যগুলো হ্যাকারদের হাত থেকে কিংবা এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে নিরাপদ কি না সে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না কোনো দেশই। স্বাভাবিক সময়ে এ ধরনের অ্যাপ ব্যবহারে নাগরিককে বাধ্য করা সংবিধানবিরোধী এবং স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ হিসেবেই বিবেচিত হতো। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতে চীন, উত্তর কোরিয়ার মতো ইউরোপ–আমেরিকার জনগণকেও কঠোর রাষ্ট্রীয় নজরদারির আওতায় পড়তে হচ্ছে।

অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বেই গণতান্ত্রিক কাঠামো আজ হুমকির সম্মুখীন। সান্ধ্য আইন, গণতান্ত্রিক জমায়েতে হস্তক্ষেপ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে গমনে বাধা দেওয়া এখন আর ‘অগণতান্ত্রিক’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না।

দেশগুলো যেমন একদিকে উদারনৈতিক গণতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে গণমাধ্যমও রাখতে পারছে না উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ব্যক্তির ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি পাচ্ছে বৈধতা। দেশে দেশে নাগরিক সচেতনতা গড়ে না উঠলে এবং জনগণ রাষ্ট্রকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে বাধ্য না করতে পারলে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী হবে, সে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি না পেলে হয়তো করোনাভাইরাসে মৃত্যু হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় নাম হবে ‘গণতন্ত্র’।

* শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়