বুয়েটে এক সকাল চাই

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

বুয়েটে ক্লাস করেছি মাত্র তিন সপ্তাহ। কলেজের চৌকাঠ পেরিয়ে বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর আশা–আকাঙ্ক্ষার হিসাব মেলানোর আগেই করোনার ধাক্কা। সবেমাত্র হলে উঠেছিলাম, রুমটাও বোধ হয় গুছিয়েছি কি গোছানো হয়নি, অগত্যা তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ির পথ ধরতে হলো। এরপর সেই যে শুরু হয়েছে, অবসর কাটানোর অবসর খুঁজতে খুঁজতেই হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। কিন্তু আশা হারাইনি, আবার ফিরব সেথায়। অন্য রকম একটি দিনে, অন্য রকম একটি সকালে।

সেদিনের সকালটা একেবারে অন্য রকম হবে। আমি মনে হয় তার আগের দিন সন্ধ্যায় আবার হলে ফিরে যাব। সোহরাওয়ার্দী হলের গেট চিনতে ভুল করে শেরেবাংলা হলেও ঢুকে পড়তে পারি। পলাশীর কর্নার দিয়ে ঢুকলে অবশ্য সেসব ভয় নেই। যাহোক, সেই সকালেও অ্যালার্ম বাজবে। রুমের বাকি সবাইকে জাগিয়ে আমিও যখন থাকব ঘুমে, তখন ওদেরই কেউ হয়তো আমাকে ডেকে দেবে। হুড়মুড় করে উঠে বসব আমি। আটটার ক্লাস ধরতে হবে যে। হঠাৎ মনে হয় কোনো এক আশঙ্কা, ভয় আমাকে ঘিরে ধরবে। ঘুম ঘুম চোখে মাথাটা পরিষ্কার হতেই আমার মনে পড়বে, গত এক মাসে দেশে কোনো করোনাভাইরাসের রোগী ধরা পড়েনি। স্কুলে স্কুলে ভ্যাকসিন ক্যাম্প বসেছে। ইনজেক্ট করে তা দেওয়া হয়েছে আমার গায়েও। যশোর ছাড়ার আগেই তা আমি নিয়ে এসেছি।

মাথাটা ডানে বাঁয়ে দোলাতে দোলাতে হয়তো আমার এসব মনে পড়বে। দীর্ঘ কোয়ারেন্টিনের দুঃস্মৃতি মনে করে হঠাৎ করে বুকের ভেতরে ছ্যাৎ করে উঠলে আমাকে মনে হয় খুব বেশি দোষ দেওয়া যাবে না। উঠে বসে বাথরুমের দিকে যাব। জটলা পাকিয়ে কয়েকজনকে গল্প করতে দেখব। আহা! চোখ জুড়িয়ে যাবে যেন। এমন জটলা কত দিন হয় না! এমন ভয়হীন, সংকোচহীন, আশঙ্কাহীনভাবে কত দিন মানুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলে না! সোহরাওয়ার্দী হলের সবচেয়ে ওপরের তলাটি তখন যেন পুরো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। সেই সকালে সেই সময়ে শাপলা চত্বরে বাস ধরতে কেউ ভয় পাবে না, ভয় পাবে না স্কুলের সেই বাচ্চাটি যে লাইনে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবে!

সেদিন হবে দীর্ঘ ছুটির পর বুয়েটের প্রথম ক্লাস। হল থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিন থেকে নাশতা করব, সেটাও নিঃসংকোচে। অভ্যাসবশত এক কাপ কফি হাতে নিয়ে ছুটে যাব বুয়েটের দিকে। বাইরে বের হয়েই কি একটা ধাক্কা খাব? সেন্ট্রাল রোডের ভিড় কত দিন পর দেখব? হিসাবটা কি মাস ছাড়িয়ে বছরে যাবে? যেখানেই যাক, যাবে তো! গাড়ির সারি কাটিয়ে আমি পার হয়ে যাব রাস্তা। যাদের ক্লাস নয়টায় থাকবে, তারা ব্যাগ কোলে নিয়ে হাফ ওয়ালে বসে গল্প করবে। সেদিন আর কাউকে তিন ফুট দূরে দূরে থাকতে হবে না। গল্প করতে করতে একে অপরের পিঠে চাটি মারতে আর বারণ থাকবে না। যাদের ক্লাস আটটায় থাকবে, তাদের অবশ্য এসবের সুযোগ নেই। পড়িমরি করে ঢুকে পড়তে হবে বিল্ডিংয়ে। লাল মেকানিক্যাল বিল্ডিংটায় ঢুকে আমি দাঁড়িয়ে যাব লিফটের লম্বা সারির সামনে। তিন ফুট দূরে দূরে নয়, সব হবে আগের মতো। ওপর থেকে লিফটটি নিচে নামবে। সবাই মিলে ঢুকে যাবে। করোনার ভয় জয় করা গেছে, লিফটে চড়তে আর কোনো ভয় নেই!

লিফটের মধ্যে সবাই গাদাগাদি করে থাকবে। সবচেয়ে ওপরের তলায় লিফট পৌঁছবে। ছুটে চলে যাব ক্লাসের দিকে। পুরোনো সেই চিরচেনা ক্লাস। সবাই সবার সঙ্গে মন খুলে গল্প করছে, এমন একটি দৃশ্য দেখার জন্যই মনে হয় আমরা সবাই বেঁচে আছি। হেঁটে হেঁটে ক্লাসের একেবারে শেষের বেঞ্চের দিকে এগিয়ে যাব। কয়েক মাস আগেও এমন এক সকালে একা একা বসে থাকতাম, এমনটা ভাবতে ভাবতেই কোনো এক বন্ধু এগিয়ে এসে আমাকে হয়তো জড়িয়ে ধরবে! কত দিন পর যেন দেখা হলো…দিন, মাস, বছর?

জানি না। কিন্তু হবে তো একদিন! ওর সঙ্গেও গল্প করব। কেমন করে কাটিয়েছে সবগুলো দিন জিজ্ঞেস করব। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্তই ছিলাম। নিয়মিতই একে অপরের খোঁজ রাখতাম। তবু স্পর্শহীন জগতে চোখের তৃষ্ণা তো মেটে না, মিটতে চায় না। সামনাসামনি গলার স্বরটা একটু চড়িয়ে যেভাবে জিজ্ঞেস করব, টাইপিংয়ের পর কয়েকটা ইমোজি দিয়ে তো আর কখনো ওভাবে জিজ্ঞেস করা হবে না।

যেই বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস করব সে হয়তো খুব আক্ষেপ করে বলবে, ভার্সিটি লাইফ শুরু না হতেই ফিরে যেতে ওর ভালো লাগেনি। খুব স্বাভাবিক একটা কথা, খুব সহজ একটি বাক্য, জানা একটি বিবরণ। তবু তা ভালো লাগবে। করোনার ভয়ে ওকে কাছে ঘেঁষতে নিষেধ করা লাগবে না। ও বকে যাবে ওর মতোই। মাঝে আরও দু–একজন এসে জুটবে। কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে, কেউবা থাকবে বসে। কিন্তু সবাই যখন গোল হয়ে ওই সকালে আড্ডা দেব, একে অপরের থেকে তিন ফুট দূরে থাকা তো দূরের কথা, আড্ডা-বৃত্তের ব্যাসার্ধও তিন ফুট হবে না।

স্যার ক্লাসে আসবেন। এক বেঞ্চে ঝটপট কয়েকজন বসে যাব। সেদিন সবাইকে অন্য রকম লাগবে। সেই সকালটাই যে অন্য সব সকালের চেয়ে অন্য রকম হবে। আড়াইটার ল্যাবের কথা চিন্তা করে সেই সকালে আর চাপ অনুভব করব না, সেই সকালে সবকিছুই আনন্দের লাগবে। বেশি রাতে ঘুমিয়ে তড়িঘড়ি ওঠার জন্য রাগ হবে না, দ্রুত ক্লাস ধরতে ছোটার জন্য বিরক্ত লাগবে না, তাড়াতাড়ি রাস্তা পার হওয়ার সময় গাড়ির সারি দেখেও কপাল কুঁচকাব না।

সেই সকালটা এমন এক সকাল হবে, পৃথিবীর কোনো কিছুকেই আর সেদিন বিরক্তিকর মনে হবে না। নিয়মকানুনের বেড়াজালে সবকিছু আটকে থাকবে না। পলাশীর ফুড কর্নারে আবার খাবারের মেলা বসবে, জুস কর্নারে দেদার জুস বিক্রি হবে। সেই খাবার, সেই জুসে কোনো ভাইরাস আছে কি না, কেউ সন্দেহ প্রকাশ করবে না। ফেলে যাওয়া একটা ক্যাম্পাসে ফিরে এসে আবার সব হয়ে যাবে আগের মতো, আবার সব হতে থাকবে আগের মতো।

সেই সকালটা আরও অন্য রকম হবে। বুয়েট ক্যাফেটেরিয়া সেদিন জমে উঠবে আবার কোলাহলে। চারজনের টেবিলে সেদিন আবার আটজন বসে যাবে অনায়াসে, কোনায় যে বসবে, তার হয়তো বসার জায়গা কম পড়ে যাবে, কিন্তু আড্ডার ছলে তা মানিয়ে নেওয়া যাবে। আড্ডা দিতে দিতে গল্প হবে, বাসায় থেকে কী কী মজার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলো। সেই মজার অভিজ্ঞতা শুনে হো হো করে হেসে উঠবে পুরো টেবিল। সেই টেবিলের দিকে পাশের টেবিলে বসা কেউ বিরক্তি নিয়ে তাকাবে না। এত মাস ধরে যে দৃশ্যের জন্য আরাধ্য ছিল কেউ, তাতে কি কারও বিরক্তি আসতে পারে? তবে সব গল্পই মজার হবে না। প্রাণঘাতী ভাইরাসে হয়তো কারও কারও আত্মীয় এপারের মায়া ছেড়ে ওপারে পাড়ি দিয়েছে, এত দিন ধরে একা একা পাওয়া সেই দুঃখটা সে এবার পুরো টেবিলটাকেই বলবে। শুনতে শুনতে নীরব হয়ে যাবে বাকি সাতজন। এই নীরবতাটুকু, এই কোলাহলজুড়ে থাকা ক্যাফেটেরিয়ায় এক টেবিল নিঃস্তব্ধতাটুকু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় কত দিন অপেক্ষা করেছে স্বজন হারানো সে?

বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ায় খাবার আনতে সেদিনও টোকেন দেওয়া হবে। টোকেন নিয়ে খাবার আনতে গিয়ে গায়ে গায়ে পড়তে হবে, সামনে ঝুঁকে টোকেনটা দিয়ে খাবারের প্লেটটা নিতে হবে। তাতে কি?

র‍্যাগ কর্নার থেকে মিউজিকের আওয়াজে অডিটরিয়ামের সামনের জায়গাটুকু মেতে থাকবে। হাফ ওয়ালে বসা কেউ সেই মিউজিক শুনে আর উঠতে চাইবে না। অর্থহীন, শিরোনামহীনের সুরে সেদিনের ক্যাম্পাসটা আবার প্রাণ ফিরে পাবে। সেই প্রাণের মায়ায় ডুবে সবাই মনে করবে নিষ্প্রাণ কাটানো দিনগুলো!

কিন্তু, সেই সকালটা আসবে কবে?


* শিক্ষার্থী, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট। [email protected]