বেওয়ারিশ নূর হোসেন চত্বর!

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিস্মারক নূর হোসেন চত্বর। অন্যান্য সময় এর গায়ে পোস্টার–ব্যানার সাঁটা থাকলেও গত তিন দিনে সব ধুয়ে–মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে লাল রং। ছবিটি গতকাল বিকেলে তোলা l প্রথম আলো
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিস্মারক নূর হোসেন চত্বর। অন্যান্য সময় এর গায়ে পোস্টার–ব্যানার সাঁটা থাকলেও গত তিন দিনে সব ধুয়ে–মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে লাল রং। ছবিটি গতকাল বিকেলে তোলা l প্রথম আলো

ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে ব্রেক কষে রাজধানীর জিপিও ভবনের ফুটপাত ঘেঁষে একের পর এক বাস থামে। চালকের তরুণ আর কিশোর বয়সী সহকারীদের হাঁক, ‘জিরো পয়েন (পয়েন্ট)। নামেন। বাম পাও আগে। নামেন...’।

জিপিও ভবনের ফুটপাত থেকে ২০ হাত দূরের লাল চত্বর জিরো পয়েন্টের নামকরণ নূর হোসেন চত্বর হয়েছে বহুদিন হলো। কিন্তু সেই নামে ডাকে না কেউ। চত্বরের দেয়ালে লেখা শহীদ নূর হোসেনের নামটি প্রায়ই ঢাকা পড়ে থাকে স্থানীয় রাজনৈতিক ও শ্রমিকনেতাদের পোস্টারের আড়ালে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের এই শহীদ সম্পর্কে ৩০ বছরেও কোনো স্মৃতি বা পরিচিতি ফলক স্থাপিত হয়নি সেখানে। বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে আছে নূর হোসেন চত্বর।

‘স্বৈরাচার নিপাত যাক/ গণতন্ত্র মুক্তি পাক’, বুকে-পিঠে এই স্লোগান লিখে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন পুরান ঢাকার বনগ্রাম লেনের নূর হোসেন। ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে গণমিছিলের একপর্যায়ে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট স্কয়ার এলাকায় গুলিবিদ্ধ হলেন তিনি। নূর হোসেনের মৃত্যুতে আন্দোলন আরও জোরালো হলো। নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বর পতন হলো এরশাদ সরকারের। এই শহীদের সম্মানে পরে জিরো পয়েন্টের নাম হয় নূর হোসেন চত্বর।

চত্বরটি প্রায় সারা বছরই ঢাকা থাকে নানা ব্যানার-পোস্টারে। লাল চত্বরটির গায়ে খোদাই করা নূর হোসেনের নামের চেয়ে ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলার দূরত্বনির্দেশক তথ্যগুলোই চোখে পড়ে বেশি।

গত বছরের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসে চত্বরটি ঢাকা পড়ে ছিল নানা আকারের ১৩টি ব্যানারে। নূর হোসেনের নাম খোদাই করা চারটি পিলারের তিনটিই ছিল ব্যানারের আড়ালে। গত শনিবার গিয়েও দেখা যায়, নূর হোসেন চত্বর ব্যানার-পোস্টারে ছাওয়া।

তবে গত বুধবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, চত্বরের রং ফেরানোর প্রস্তুতি চলছে। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পোস্টারের টুকরো দেখে বোঝা যায়, সদ্যই চত্বরের গা থেকে তোলা হয়েছে সেগুলো। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল মজুমদার প্রথম আলোকে বললেন, বছর দুই ধরে চত্বরটি রং করা হয়নি বলে এই উদ্যোগ। নূর হোসেন দিবসের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই।

জিপিওর ফুটপাতে পোশাক বিক্রি করেন জাহাঙ্গীর আলম। আঙুল তুলে ‘নূর হোসেন চত্বর’ শব্দ তিনটির দিকে দৃষ্টি ফেরালে বললেন, ‘নূর হোসেন লেখছে কিন্তু আসল নাম জিরু পয়েন্ট। এইডাই ডাকে।’

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের কথোপকথন দাঁড়িয়ে শুনছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. খুরশেদ আমির। বললেন, ‘এটা যে নূর হোসেন চত্বর, এইটা ওরা জানবে কীভাবে? তাঁর কোনো ভাস্কর্য বা পরিচিতি বোর্ড থাকলে মানুষ জানতে পারত। স্কুলের ছেলেমেয়েরা যাওয়া-আসার পথে দেখত।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিল্লাল বলেন, ফুটপাত ও অন্যান্য স্থাপনা সংস্কার প্রকল্পের অধীনে এই চত্বরটিরও সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে। তবে নূর হোসেন সম্পর্কে কোনো স্মৃতিফলক বা পরিচিতি ফলক স্থাপনের পরিকল্পনা তাঁদের নেই।