বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ইউরিয়া

মাঠে এখন আমন ধান। সার দেওয়ার মূল সময় চলছে। ঠিকমতো সার না দিলে উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। ফলে জিম্মি হয়ে পড়ছেন কৃষক।

আমন ধানের খেতে এখন সার দেওয়ার মূল সময়। এর মধ্যে বেশি দেওয়া হয় ইউরিয়া সার। কিন্তু ইউরিয়া কিনতে গিয়ে ঠকছেন কৃষক। ডিলার থেকে খুচরা ব্যবসায়ী—সবাই বেশি দামে ইউরিয়া সার বিক্রি করছেন। ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ইউরিয়ার সরকারনির্ধারিত দাম ৮০০ টাকা। যশোর, ফরিদপুর, নওগাঁ ও টাঙ্গাইল জেলায় প্রতি বস্তা সার ৫০ থেকে ৪০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশে আমন মৌসুমে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার লাগে। সেপ্টেম্বর মাসে ইউরিয়া বেশি ব্যবহৃত হয়। সারা দেশে এ মাসের জন্য চাহিদা ১ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ১ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কিছুদিন আগে বরিশাল, খুলনা অঞ্চলে সারের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছিল, তা মেটানো হয়েছে। এখন কোথাও ইউরিয়া সারের সংকট বা বেশি দামে বিক্রির তথ্য তাঁদের কাছে নেই।

যশোরে দাম সবচেয়ে বেশি

যশোরে নির্ধারিত দামের চেয়ে ৪০০ টাকা বেশি দরে প্রতি বস্তা ইউরিয়া সার বিক্রি হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। জেলার অভয়নগর উপজেলার বাণীপুর গ্রামের কৃষক ইয়াসিন মোড়ল এবার সাড়ে তিন বিঘায় আমনের চাষ করেছেন। ১ হাজার ২০০ টাকায় এক বস্তা ইউরিয়া কিনে জমিতে দিয়েছেন। এক কেজির দাম পড়েছে ২৪ টাকা। অথচ প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের সরকারি দাম ১৬ টাকা।

বাঘারপাড়া উপজেলার ধূপখালী গ্রামের কৃষক গোলাম খাইবার আমন চাষ করেছেন সাত বিঘায়। তিনি এ পর্যন্ত ছয় বস্তা ইউরিয়া কিনে খেতে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি দুই বস্তা ইউরিয়া ৯৫০ টাকা এবং চার বস্তা ইউরিয়া ৯২০ টাকা করে কিনেছি। সরকারি দাম কত জানি না। আমি দোকান থেকে এই দামেই সার কিনেছি।’

যশোর জেলায় বিসিআইসির (বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থা) ডিলার রয়েছেন ১৪২ জন। সরকারনির্ধারিত খুচরা সার ব্যবসায়ী আছেন ৬৫৭ জন। কৃষি কর্মকর্তা ও ডিলাররা জানান, জেলায় গত আগস্টে ইউরিয়ার বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার ৯৩৩ মেট্রিক টন। উত্তোলন করা হয়েছে ৫ হাজার ৮৫ মেট্রিক টন।

কৃষক বলছেন দাম বেশি, ডিলার বলছেন ‘না’

ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার তুজারপুর ইউনিয়নের জান্দি গ্রামের কৃষক নাসিম মোল্লা প্রতি বস্তা সার কিনেছেন ৯০০ টাকা দরে। তিনি জানান, গত মঙ্গলবার তিনি ইউনিয়নের উচা বাজার থেকে ওই সার কেনেন। ১৬ টাকার জায়গায় প্রতি কেজির দাম নিয়েছে ১৮ টাকা।

জেলায় সারের ডিলার আছেন ৯৬ জন। খুচরা সার বিক্রেতা আছেন ৭২৯ জন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ফরিদপুরে বছরে ইউরিয়ার চাহিদা ৭৭ হাজার মেট্রিক টন। বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৩৯ হাজার মেট্রিক টন।

শহরের টেপাখোলা মহল্লার খুচরা সার বিক্রেতা মেসার্স মৃধা ট্রেডার্সের মো. লিটন মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ডিলারদের কারসাজিতে সারের দাম বাড়ছে। কৃষকেরা বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।

স্থানীয় ডিলার আবু সাঈদের ব্যবস্থাপক রুহুল আমিন বলেন, তাঁরা বেশি দামে সার বিক্রি করেন না। তবে মাঝেমধ্যে সারের সরবরাহ পেতে সমস্যা হয়।

ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার ফুলসূতী ইউনিয়নের বাউতিপাড়া গ্রামের কৃষক বরুণ মণ্ডলকে প্রতি বস্তা সার ৯২৫ থেকে ৯৫০ টাকায় কিনতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হযরত আলী বলেন, এ জেলায় সারের সংকট হওয়ার কথা নয়।

মৌসুমের শুরুতে নির্ধারিত দামে বিক্রি

আমন মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে এসে হঠাৎ করে ইউরিয়া সারের দাম বেড়েছে বলে জানান নওগাঁর একাধিক কৃষক। তাঁদের অভিযোগ, মৌসুমের শুরুতে ৮১০ থেকে ৮২০ টাকা দরে প্রতি বস্তা সার বিক্রি হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে প্রতি বস্তা ইউরিয়া সার খুচরা পর্যায়ে ৮৬০ থেকে ৯২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

গত বুধবার দুপুরে নওগাঁ সদর উপজেলার ঠ্যাংভাঙার মোড় এলাকায় কথা হয় শিবপুর গ্রামের কৃষক আবদুল জব্বার, সাইদুর রহমান ও শহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, আগস্টের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরিয়ার দাম বাড়তে শুরু করেছে। এখন নওগাঁ সদরের পাহাড়পুর ও তিলকপুর বাজারে প্রতি বস্তা ইউরিয়া বিক্রি হচ্ছে ৯২০ টাকা দরে।

পাহাড়পুর বাজারের খুচরা সার বিক্রেতা জাহিদুর রহমান ও আক্কাস মণ্ডল বলেন, ডিলারদের কাছ থেকেই তাঁদের ৮৬০ থেকে ৮৭০ টাকায় প্রতি বস্তা ইউরিয়া কিনতে হচ্ছে। ফলে পরিবহন খরচ যোগ করে খুচরা পর্যায়ে সেই সার কেউ ৮৯০, কেউ ৯০০ টাকা বস্তা হিসেবে বিক্রি করছেন।

বস্তায় দুই কেজি কম!

টাঙ্গাইলে কৃষক পর্যায়ে প্রতি বস্তা ইউরিয়া বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ থেকে ৯৫০ টাকায়। বস্তা খুলে প্রতি কেজি সার বিক্রি করা হচ্ছে ১৮ টাকায়। বুধবার টাঙ্গাইল সদর, কালিহাতী ও মধুপুর উপজেলার কয়েকটি স্থানে খুচরা বিক্রেতা এবং কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া যায়।

সদর উপজেলার দাইন্যা ইউনিয়নের খুচরা ব্যবসায়ী মুনছুর মিয়া জানান, ৫০ কেজির সারের বস্তায় কমপক্ষে দুই কেজি কম থাকে। তাই বাধ্য হয়ে তাঁদের কিছু বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।

বাঘিল ইউনিয়নের ঢালান শিবপুর বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী আনছার আলী জানান, প্রতি বস্তা ইউরিয়া তাঁরা ৯০০ টাকায় বিক্রি করছেন। পরিবহন খরচ, দোকান ভাড়া বেশি হওয়ায় নির্ধারিত মূল্যের কিছু বেশিতে বিক্রি করতে হচ্ছে।

[প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মাসুদ আলম, যশোর; প্রবীর কান্তি বালা, ফরিদপুর; ওমর ফারুক, নওগাঁকামনাশীষ শেখর, টাঙ্গাইল]