বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘ব্যবস্থা নিচ্ছি’তে সীমাবদ্ধ ইসি

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর আচরণবিধি ভঙ্গ, হামলা–হুমকিসহ একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ছে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ সংখ্যা ৫৩টি। এসব অভিযোগের বিপরীতে ব্যবস্থা বলতে মৌখিক সতর্ক আর কিছু ক্ষেত্রে সামান্য জরিমানা করা হয়েছে। বেশির ভাগ অভিযোগের বিষয়ে ‘তদন্ত চলছে’ বা ‘ব্যবস্থা নিচ্ছি’তে সীমাবদ্ধ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভূমিকা।

ইসির এমন ‘দায়সারা’ ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটির অভিযোগ, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের বিপরীতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর আওয়ামী লীগের দাবি, অভিযোগ করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় বিএনপি।

২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে। ভোট যত এগোচ্ছে, নির্বাচনের মাঠ তত উত্তপ্ত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাতে দুজন খুন হয়েছেন। প্রতিদিনই ছোটখাটো ঘটনা ঘটছে। গত বুধবার একদিনে চট্টগ্রামের তিনটি স্থানে হামলা ও সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। সংঘাতের ঘটনায় ফৌজদারি মামলা হলেও অভিযোগের বিষয়ে ইসি চলছে ধীরে।

১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সাংসদ মোশাররফ হোসেনের স্বাক্ষরে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দল–সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের তালিকা ছাপানো হয়। তিনি আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক। মোশাররফ হোসনের বিরুদ্ধে ১৯ জানুয়ারি আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ দেয় বিএনপি। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অভিযোগটি যাচাই করা হচ্ছে বলে জানায় ইসি। আবার নির্বাচনের প্রচারের প্রথম দিনে (৮ জানুয়ারি) আচরণবিধি লঙ্ঘন করে দক্ষিণ পাহাড়তলীতে গাড়ির বহর নিয়ে প্রচার চালান আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী। ব্যস্ততম সড়ক আটকে করেন পথসভা। ছবিসহ এ খবর ছাপা হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এ নিয়ে অভিযোগ দেয় বিএনপি। তবে ইসি বলছে, তদন্ত করে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি।

ইসি সূত্র জানায়, রিটার্নিং কর্মকর্তা এ বিষয়ে তদন্ত করতে পাহাড়তলী ও আকবরশাহ থানা–পুলিশকে দায়িত্ব দেন। দুই থানার ওসি জানান, যানজটের কারণে রেজাউল করিম চৌধুরীর পেছনের গাড়িগুলোকে তাঁর বহরের গাড়ি মনে হয়েছে।

রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন যে অভিযোগ পাচ্ছি, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ফৌজদারি বিষয়ে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে বলা হচ্ছে। অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা ঘটনার তদন্ত করে দেখে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আমাদের যদি আরও কঠোর হতে হয়, হব।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী। শুক্রবার বিকেলে নগরের পতেঙ্গা লালদিয়ার চর এলাকায়।
ছবি: সৌরভ দাশ

ইসিতে জমা পড়া ৫৩টি অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেনের পক্ষে এ পর্যন্ত ১২টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এতে চারটি হামলার ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়। হামলার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানাকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে ইসি। এটাকে ইসির দায়সারা ভূমিকা বলছে বিএনপি। দলটির দাবি, তাদের বাকি অভিযোগের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অভিযোগ দিলেও ইসি যথাযথ ব্যবস্থা নেয় না। আমাদের দাবি ছিল অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা। দিন দিন মনে হচ্ছে প্রশাসন সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে। পুলিশ আমাদের লোকজনকে হুমকি দিচ্ছে।’

আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী অভিযোগ জমা দেন তিনটি। এর মধ্যে রয়েছে দুটি নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর ও পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ। তবে ইসির ভূমিকা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি অভিযোগের দল। তারা কেবল অভিযোগ করে যায়। দলটি ক্রমাগত আচরণ বিধি ভঙ্গ করে যাচ্ছে।’

ইভিএমের সুরক্ষা নিয়ে ভাবনা

২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৯ কোতোয়ালি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হয়। তখন আওয়ামী লীগের মহিবুল হাসান চৌধুরীর বিপক্ষে বিএনপির প্রার্থী হয়েছিলেন শাহাদাত হোসেন। নির্বাচনের পর ইভিএম বেদখল ও গোপন কক্ষে বহিরাগতের উপস্থিতিসহ নানা বিষয়ে অভিযোগ দিয়েছিলেন শাহাদাত।

এখন পর্যন্ত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাতে দুজন খুন হয়েছেন। প্রতিদিনই ছোটখাটো ঘটনা ঘটছে। সংঘাতের ঘটনায় ফৌজদারি মামলা হলেও অভিযোগের বিষয়ে ইসি চলছে ধীরে।

সেই অভিজ্ঞতায় এবারও শাহাদাত হোসেন ইভিএম ও গোপন কক্ষের নিরাপত্তার পাশাপাশি বহিরাগত ঠেকানোর দাবি জানিয়েছেন। তিনি গত বৃহস্পতিবার রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার দাবিতে আটটি লিখিত দাবি জানান। এর মধ্যে ইভিএম প্যানেলকে সুরক্ষা এবং সেনাবাহিনী, র‍্যাব, বিজিবি ও পুলিশের সমন্বয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির দাবি অন্যতম। এ প্রসঙ্গে শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘অতীতেও ইভিএমে জালিয়াতি হয়েছে। তাই সশস্ত্র কর্মকর্তা নিয়োগ করে ইভিএম প্যানেলের নিরাপত্তা চেয়েছি।’

রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির প্রার্থীর দাবিগুলোর বিষয়ে ইসিতে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ইসির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন কাউন্সিলর প্রার্থীদের

অভিযোগের মধ্যে ৩৮টি কাউন্সিলরদের। এর মধ্যে ২০টি একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর। এর মধ্যে পোস্টার–ব্যানার ছেঁড়া, প্রচারে বাধা, আচারণবিধি লঙ্ঘন, হুমকি ও গাড়িবহর ব্যবহার অন্যতম অভিযোগ।

আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলরদের কারণে কয়েকটি ওয়ার্ডে উত্তেজনা লেগে রয়েছে। প্রায় ৩২টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে। এর মধ্যে পাঠানটুলী, উত্তর পাহাড়তলী, সরাইপাড়া, রামপুর, জালালাবাদ, ফিরিঙ্গীবাজার ও লালখান বাজার ওয়ার্ডে উত্তেজনা বেশি।

চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়া এলাকায় গণসংযোগ করেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন। শুক্রবার বেলা ১১টায় বাকলিয়া রাহাত্তার পুল এলাকায়।
ছবি: জুয়েল শীল

মেয়র প্রার্থীর মতো কাউন্সিলরদের অভিযোগেরও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন প্রার্থীরা। ফিরিঙ্গীবাজার ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হাসান মুরাদ ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন পরস্পরের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা দিয়েছেন। কিন্তু কোনোটির বিষয়ে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ দুজনেরই।

আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য নগরে ১৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁরা প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে ঘুরে পোস্টার–ব্যানারসংক্রান্ত আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় জরিমানাসহ নানা ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে জানান রিটার্নিং কর্মকর্তা।

তবে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে না বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের অনেক ক্ষমতা। কিন্তু তা ব্যবহার করে না, যার কারণে সরকার বা ক্ষমতাসীন কোনো প্রার্থী নির্বাচনে অবৈধ সুযোগ নেন। ফলে নির্বাচনী পরিবেশ নিরপেক্ষ থাকে না।